• শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

যেখানে বাংলা ভাষা নিয়ে গরব নাই, আশাও নাই

প্রকাশ:  ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:৩৩ | আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:৩৭
মালবী গুপ্ত
মালবী গুপ্ত, সাংবাদিক, কলকাতা

নাহ্ বলতেই হচ্ছে, আ মরি বাংলা ভাষা আর মোদের গরবও নয়, মোদের আশাও নয়। অন্তত পশ্চিমবঙ্গে। থাকলে, আমার মনে হয়, বাংলা ভাষাকে আজ এমন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হত না। তার অস্তিত্বের সঙ্কট সম্ভাবনায় অনেককেই ইদানিং এত বিচলিতও হতে হত না।বিশেষত নবীন প্রজন্মের মুখে মুখে আজ উদভ্রান্তের মতো ধাক্কা খেয়ে ফিরতে হত না হিন্দি, ইংরেজি মেশানো এক জগাখিচুড়ি বাংলাভাষাকে ।

ইউনেস্কোর মতে ১০,০০০ এর কম মানুষ যে ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষার বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেই হিসেবে ভারতে এখনও পর্যন্ত পাওয়া ৭৮০ ভাষার মধ্যে বিপদ সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ৬০০টির । এবং জানা যাচ্ছে গত ৬০ বছরে প্রায় ২৫০ ভারতীয় ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

কি জানি, বাংলাভাষাও দূর ভবিষ্যতে এমন বিপদ সম্ভাবনার তালিকায় নাম লেখাবে কী না।

অবশ্য অনেকের মনে হতে পারে এই ভাবনা অহেতুক। কারণ বিশ্বে সর্বাধিক মানুষের কথা বলার ভাষা হিসেবে ষষ্ঠ নাকি সপ্তম স্থানে থাকা বাংলাভাষীর সংখ্যা এখন প্রায় ২৩ কোটি।

মনে হতে পারে, একটা ভাষা তো বেঁচে থাকে এবং সমৃদ্ধ হয় বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করেই। এবং এও মনে হতে পারে, প্রতি বছর পশ্চিমবঙ্গে যখন হাজার হাজার বাংলা বই প্রকাশিত হচ্ছে, তখন এর মৃত্যু ঘণ্টা বাজাবে কে? তবে মৃত্যু না হলেও সে যে ক্রমে রক্তহীন হচ্ছে, চারপাশে একটু সজাগ দৃষ্টিপাতেই তা টের পাওয়া যায়।

কারণ, যে মাতৃভাষার আন্দোলন বাংলাদেশকে প্রসব করেছে, যে আন্দোলনের হাত ধরে সারা বিশ্ব ২১শে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পেয়েছে, সেই ভাষা নিয়ে সেই দেশবাসীর চূড়ান্ত আবেগ এবং গভীর ভালবাসা হয়তো স্বাভাবিক।

অপর দিকে, পশ্চিমবঙ্গের জন্ম বাংলাদেশের মত কোন রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে হয় নি। রাজ্যবাসীদের কাছে বাংলাভাষা অনেকটাই যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। তাই তাকে নিয়ে কোন বিশেষ আবেগ নেই আমাদের। বরং যা রয়েছে তা হল কিছুটা অবজ্ঞা মিশ্রিত অবহেলা।

তাই বোধহয়, যে ভাষাটির জন্ম ও চর্চা হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে, যে ভাষা বাঙালিদের বিপুল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক - সেই ভাষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কিছুটা নাকে কাঁদুনি গেয়েই আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসীরা ক্ষান্ত থাকি। বলা যায় 'আত্মবিস্মৃত বাঙালি' জাতি আমরা বাংলাকে নিয়ে বোধহয় একটা হীনমন্যতাতেও ভুগি। কারণ প্রায়শই দেখা যায়, যত শিক্ষিতই হোক, ইংরেজি না বলতে পারলে আমাদের তথাকথিত 'শিক্ষিত সমাজ', তাকে যেন একটু খাটো নজরেই দেখে।

বহু বাঙালিই আড্ডায়, আলোচনায় এমনকি নিজেদের বাড়িতেও বাংলা নয়, ইংরেজি বলতেই বেশি পছন্দ করেন। বেশি 'কমফোর্টেবল ফিল' করেন তাঁরা। নতুন প্রজন্মও বিশেষ করে কলকাতাবাসী যেন সেই পছন্দের অনুসারী হয়ে বাংলার বদলে ইংরেজি ও হিন্দি, নয়তো এই দুটি ভাষা মিশিয়ে অদ্ভুত এক জগা খিচুড়ি বাংলা বলে। আবার অফিস আদালতে বাংলা ভাষায় লেখা সরকারি কোন নির্দেশিকা বা কোন ঘোষণাপত্রে চোখ রাখলে, মনে হয় যেন ঊনবিংশ শতকি বাংলা পড়ছি।

এখন আবার সভা সমিতিতে আমাদের রাজ্যের নেতা-নেত্রী ও মন্ত্রীদের শ্রীমুখ থেকে অশ্রুতপূর্ব বাংলায় যে বক্তৃতা, কখনো আবার ছড়া-গানের ফুলঝুরি আমাদের কর্ণপটাহকে বিদীর্ণ করে - তখন আমার সত্যি মনে হয়, "মাগো তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা" র বদলে - কত অশান্তি, কত যন্ত্রণাই না আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে।

মনে হয় যে ভাষার আগে 'মাতৃ' শব্দটা জুড়ছি, তার ওপরও এমন দুরমুশ চালানো যায়? তাকে এতটাও পীড়ন করা যায়? আবার এখনকার সিনেমায়, সিরিয়ালে ব্যবহৃত নানা হিন্দি শব্দ, ডায়লগের ভগ্নাংশ, বাংলা ভাষায় তা সে যতই অর্থহীন হোক না কেন, তার যথেচ্ছ ব্যবহারেও আমরা কেমন নির্বিকার।

তাই আমাদের দেশে বাংলা ভাষা নিয়ে যুক্তি-তর্কে সভা-সমিতি, রেডিও-টিভির প্যানেল ডিসকাশন যতই সরগরম হয়ে উঠুক না কেন, পত্র-পত্রিকার পাতায় অবধি, 'মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম' এই প্রবচনের জ্ঞান গম্ভীর প্রবন্ধেই তা সীমাবদ্ধ থেকে যায়। সেই দুগ্ধের অভাব ঘটিয়ে কীভাবে আমরা নিজেরাই ভাষাকে অপুষ্ট-রিকেটি করে তুলছি - সেই ভাবনা আমাদের চেতনায় ঘা দেয় না কখনও।

ভারতে ২০১১ 'র জনগণনা রিপোর্ট বলছে, জনসংখ্যার প্রায় ৪৩.৬৩ শতাংশ হিন্দিতে কথা বলে। এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার ভাষা কিন্তু বাংলা।

হায়, তা সত্ত্বেও সে কেবলই আজ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। মনে পড়ছে, বাম আমলে সরকারি পর্যায়ে কাজের ভাষা, হোর্ডিং, সব স্কুলে বাংলা পড়ানো বাধ্যতামূলক - ইত্যাদি বিষয়ে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কলকাতায় 'ভাষা শহিদ স্মারক সমিতি' উদ্যোগী হয়েছিল। কিন্তু সে উদ্যোগ তত কার্যকর হয়নি বলেই ২০১৭তে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীকে পশ্চিমবঙ্গে সব স্কুলে বাধ্যতামূলক বাংলা পড়ানোর নির্দেশ দিতে হয়।

আমার মনে হয় বাংলাভাষা সম্পর্কে এই অবজ্ঞাই ছেলে মেয়েদের মাতৃভাষা সম্পর্কে অনাগ্রহী করেছে। অভিভাবকরাও মনে করেন বাংলাটা না জানলেও চলবে। এই অনাগ্রহ আর অবহেলার মধ্যেই কিন্তু ভাষার মৃত্যুবীজ লুকিয়ে থাকে।

ইউনেস্কোর মতে পৃথিবীর প্রায় ২৫০০ ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার বিপদ সম্মুখীন। যার মধ্যে এমন কিছু ভাষা আছে যাতে কথা বলে হয়তো আর জনা তিরিশেক মানুষ। এবং বর্তমান পৃথিবীতে মানুষ যত ভাষায় কথা বলে, তার পঞ্চাশ শতাংশই নাকি বিলুপ্ত হয়ে যাবে এই শতাব্দীর শেষে।

তাই ইউনেস্কোর কাছে ২০১০ সালে বাংলা 'পৃথিবীর সব চেয়ে মিষ্টি ভাষা'-র স্বীকৃতি পেলেও তার উচ্চারণে ভারতীয় বাঙালির নবীন প্রজন্মের বৃহদাংশের এত অনীহা দেখে আশঙ্কাই হয়, এই বুঝি বাংলা ভাষাকে তারা কাঁধ ঝাঁকিয়ে ফেলে দিল বোলে।

লেখক: সাংবাদিক, কলকাতা

পূর্বপশ্চিম-এনই

বাংলা ভাষা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close