• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ইউরোপ: টাকা হলেই বাঘের দুধ বা গ্যাস পাওয়া যায় না

প্রকাশ:  ৩০ আগস্ট ২০২২, ১৪:২৪ | আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২২, ১৪:৩৭
শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ

ইউরোপের সামনে শীতকাল। ওই মৌসুমে ঘর গরম রাখতে হিটার জরুরি। হিটারের মতো সামান্য ব্যাপার নিয়ে এর আগে কখনো দুশ্চিন্তায় থাকতে হয়নি ইউরোপকে। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো- আজ যিনি আমির, সামান্য একটি ভুল সিদ্ধান্ত কাল তাকে ফকির বানিয়ে দিতে পারে।

না। ইউরোপ ফকির হয়ে গেছে, এমন কথা বলার স্পর্ধা আমার নেই।

আমি বলতে চাচ্ছি, আপনার পেটে যদি ক্ষুধা থাকে। খাবারের খোঁজে পকেটভর্তি টাকা নিয়ে ঘুরছেন, কিন্তু কোথাও খাবার পাচ্ছেন না। তবে কি জনাব টাকা চিবিয়ে খেতে পারবেন?

ইউরোপের ধারণা ছিলো অনেকটা এমনই। দেশগুলো মনে করতো টাকা হলে বাঘের দুধ পাওয়া যায়! এরা বাঘের দুধও চাইবে, আবার বাঘের খাবারের উপর নিষেধাজ্ঞা দেবে।

ইউক্রেন যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ায় রাশিয়ার উপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া শুরু করলো পশ্চিমের দেশগুলো।

চীন ও ইরানের মতো নিন্দুক দেশগুলো বলে ইউরোপ চলে আমেরিকার ইশারায়। ইরানের নেতারা ইউরোপের দেশগুলোকে আমেরিকার গোলাম বলতেও ছাড়েন না। গোলামের নিজস্ব কোনো স্বার্থ থাকে না। গোলামেরা যা যা করে, সব মনিবের স্বার্থে।

আগ বাড়িয়ে যত গন্ডগোল পাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর ওই দেশটির হয়ে হাতাহাতিতে জড়াতে হয় ইউরোপের দেশগুলোকে।

এবারকার গন্ডগোল কিন্তু একটু অন্যরকম। ইউরোপ ভাবতেও পারেনি, রাশিয়া তাদের গ্যাস বন্ধ করে দেবে। ইউরোপের জ্বালানি চাহিদার বড় অংশ আসে রাশিয়া থেকে। কিন্তু রাশিয়া দিন দিন সেটা কমিয়ে আনছে। রাশিয়া থেকে ইউরোপে গ্যাস যায় নর্ড স্ট্রিম ওয়ান পাইপলাইনের মাধ্যমে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এই পাইপলাইন দিয়ে দফায় দফায় সরবরাহ কমিয়েছে দেশটি।

এতে হতভম্ব ইউরোপ। কেবল হতভম্বই নয়, ওদের চোখের সামনেই উদ্বৃত গ্যাস পুড়িয়ে নষ্ট করে দিচ্ছে রাশিয়া।

আপনি যখন ক্ষুধার্ত থাকবেন, তখন আপনাকে দেখিয়ে দেখিয়ে কেউ যদি গরুর কালাভুনা রান্না করে ড্রেনে ফেলে দেয়!

হ্যাঁ, ইউরোপের অবস্থাটা এমনই হয়ে গেছে। ফিনল্যান্ডের সীমান্তের কাছে পোর্তোভায়া নামের একটি প্ল্যান্টে দৈনিক এক কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের গ্যাস পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।

রাশিয়া থেকে জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ করার পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম ওয়ান যেখানে শুরু হয়েছে, সেখানকার একটি কমপ্রেশর স্টেশনের কাছে এই পোর্তোভায়ার অবস্থান।

অন্যদিকে গ্যাসের সঙ্কটে ইউরোপের অবস্থা করুণ হয়ে আসছে। ভয়াবহ একটি শীতকালের ঝুঁকিতে পড়েছে ইউরোপ। সঙ্কট মোকাবেলা কঠিন ও ব্যয়বহুল হবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা।

এ অবস্থায় গ্রাহকদের মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জার্মানি। সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ইউরোপের অন্য দেশগুলোও। এবারের শীত কিভাবে কাটানো হবে, সেটা নিয়ে চলছে নানা পরিকল্পনা।

গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে আনার প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন এক কর্মকর্তা জানান, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রতিশোধ নিতে রাশিয়া এই কাজ করেছে। এতে শীত মোকাবেলায় অনিশ্চিত অবস্থায় পড়ে গেছে গোটা ইউরোপ। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে রাশিয়া। দেশটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, যতটুকু গ্যাস দেওয়া সম্ভব, ততটুকু ইউরোপকে দিয়ে যাচ্ছে তারা।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে কিছু কারিগরি জটিলতা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রেও পড়েছে। পেসকভ বলেন, রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শেষ হলে সরবরাহ আবারো বাড়তে পারে। তবে নিষেধাজ্ঞার কারণে যদি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা না যায়, তবে সরবরাহ আর স্বাভাবিক করা সম্ভব হবে না।

ইউরোপিয় ইউনিয়নের চাহিদার ৪০ শতাংশ গ্যাস সরবরাহ করে রাশিয়া। নর্ড স্ট্রিম ওয়ান পাইপলাইন ব্যবহার করে সরবরাহ যায় সবচেয়ে বেশি। এই কাজটি করে রাশিয়ার সরকারি জ্বালানি প্রতিষ্ঠান গাজপ্রম। গাজপ্রমে প্রায় পাঁচ লাখ কর্মী কাজ করেন। এর মালিক রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বন্ধু। গ্যাস সরবরাহ কমে যাবে, এ বিষয়ে আগেই সতর্ক করেছিলো প্রতিষ্ঠানটি।

পূর্ব ইউরোপের প্রায় পুরোটাই রাশিয়ার গ্যাসের উপর নির্ভরশীল। পশ্চিম ইউরোপ নরওয়ে, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা থেকেও গ্যাস আমদানি করে। তবে ওইসব এলাকাতেও রাশিয়ার গ্যাসের দরকার হয়। রুশ গ্যাসের পুরোটাই আসে গাজপ্রমের মাধ্যমে।

গ্যাস না দেওয়ার বিষয়ে রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি সামনে আনলেও এর পেছনে রয়েছে রাজনীতি। বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্যাসের মাধ্যমে রাশিয়া মূলত পশ্চিমাদের সাথে দর কষাকষি করছে। গ্যাস দেশটির জন্য পরিণত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রে।

ইউরোপিয় ইউনিয়নের জ্বালানি নীতির প্রধান কাদরি সিমসন বলেন, ‘এর পেছনে কারিগরি কোনো কারণ নেই, সেটা আমরা জানি।’

তবে ক্রেমলিন থেকে দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন ইউরোপে সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে চায় না রাশিয়া। নিষেধাজ্ঞা এবং বিধিনিষেধের বাড়াবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে পারে।

নিষেধাজ্ঞাগুলো বিশ্বব্যাপি এনার্জির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে এর আগে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলনস্কি বলেন, “রাশিয়া ইউরোপের বিরুদ্ধে ‘প্রকাশ্য গ্যাসযুদ্ধ’ চালাচ্ছে।'

জার্মানির অর্থমন্ত্রী রবার্ট হ্যাবেক বলেন, ‘পুতিন একটি বিশ্বাসঘাতক খেলা খেলছেন।’

এই খেলা ইউরোপকে ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে বৈঠকে বসেছেন ইউরোপিয় ইউনিয়নের জ্বালানি মন্ত্রীরা। আগস্ট থেকে মার্চ পর্যন্ত গ্যাসের ১৫ শতাংশ ব্যবহার কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছেন তারা। এতে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস সংরক্ষণে থাকবে।

ইউক্রেন সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই গ্যাসের ক্ষেত্রে রাশিয়ার উপর নির্ভরতা কমাতে চেস্টা করে যাচ্ছে পশ্চিমের দেশগুলো। বিভিন্ন দেশকে বিকল্প সন্ধানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, বিকল্প খুঁজলেও রাশিয়াকে একেবারে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়।

পরিস্থিতি মোকাবেলায় কিছু প্রস্তাব দিয়েছে অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি স্টাডিজ। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, সঙ্কট কাটাতে আরো তরল প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি করতে হবে ইউরোপকে। ইউরোপিয় ইউনিয়নের সংরক্ষিত সুবিধাগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন করতে হবে।বিজনেস ডাটা কোম্পানি ইন্ডিপেন্ডেন্ট কমোডিটি ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসেস জানিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যাপক হারে এলএনজি আমদানি করছে ইউরোপ। কাতার ও এশিয়া থেকে আমদানির বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে।

সঙ্কট মোকাবেলায় তিনটি স্তরের কথা মাথায় রাখতে পরামর্শ দিয়েছেন এক্সপার্টরা। প্রথম দুই ধাপে বাজার প্রচন্ড ধাক্কা খাবে। তখন মজুদ করে রাখা এলএনজি সরবরাহ করা হবে। তৃতীয় বা শেষ স্তর হতে পারে ভয়ঙ্কর। ওই স্তরে তৈরি হবে সত্যিকারের জরুরি অবস্থা। এমনকি ঠিকভাবে সামাল দিতে না পারলে ব্ল্যাকআউটও হয়ে যেতে পারে। ইউরোপিয় সরকারগুলোকে আগে থেকেই নিরাপদ বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্ব নেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।

জার্মানির ফেডারেল অ্যাসোসিয়েশন অফ দ্য এনার্জি অ্যান্ড ওয়াটার ইন্ডাস্ট্রিজ এর এক মুখপাত্র বলেছেন, ‘গৃহস্তালি কাজে গ্যাসের সরবরাহ অবশ্যই নিরাপদ রাখতে হবে। এটি জাতীয় দায়িত্ব।’

হাসপাতালের মতো জরুরি জায়গায় সঙ্কট দেখা দেওয়ার আগেই স্বেচ্ছায় গ্যাসের ব্যবহার কমাতে রাজি হয়েছেন ভারি শিল্প গ্রাহকরা ।

সংকট মোকাবেলায় এক হয়ে কাজ করবে ইউরোপিয় ইউনিয়ন। যাদের বেশি গ্যাস আছে তারা অন্য এলাকায় সরবরাহ করবে।

২০১৪ সালে ক্রিমিয়া সংকটের সময় রাশিয়ান গ্যাস নিয়ে একই উদ্বেগ তৈরি হয়েছিলো। তখন এই ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তখন মহাদেশীয় গ্যাস পরিবহন নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। পশ্চিম থেকে পুবে গ্যাস সরবরাহ করার ক্ষমতার উন্নতি হয়েছে।

গ্যাস সঙ্কটে ভোক্তা পর্যায়ে ব্যাপকভাবে দাম বেড়েছে ইউরোপিয় দেশগুলোতে। ব্রাসেলসভিত্তিক বিশ্লেষক জর্জ জাচম্যান মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে এনার্জি ক্ষেত্রে ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেবেব। এতে উৎপাদন খরচ বাড়বে। আর এর ফলে দেখা দেবে মুদ্রাস্ফীতি। এমন পরিস্থিতি ভোটারদের মনোভাবকে প্রভাবিত করতে পারে। ইউরোপে দেখা দিতে পারে সামগ্রীক অসন্তোষ।

অ্যালেনসবাচ ইনস্টিটিউট পরিচালিত এক জনমতে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ জার্মান মুদ্রাস্ফীতিকে উদ্বেগজনক বলে মনে করে। তাদের কাছে এই উদ্বেগ ইউক্রেনের সামরিক সংঘাত বা কোভিড-১৯ মহামারীর চাইতেও ভয়ঙ্কর।

ভারী শিল্পের দেশ জার্মানি তার শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্যাস কম ব্যবহারের আব্বান জানিয়েছে। তবে এতে শঙ্কাজনকভাবে উৎপাদন কমে যাবে বলেও পাল্টা সতর্ক করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিশ্বের বড় একটি জ্বালানি কোম্পানি শেলের প্রধান হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, ইউরোপে এবার শীতে জ্বালানি রেশনিং করতে হতে পারে। জার্মানি এরই মধ্যে গ্যাস রেশনিং প্রক্রিয়ায় অনেকদূর এগিয়ে গেছে। পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে দাঁড়ালে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবে সরকার। ঘর গরম রাখার জন্য গৃহস্তালি সংযোগ ও জরুরি সেবাগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

গ্যাসের ঘাটতি পূরণে ইউরোপজুড়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর আলোচনাও হতে পারে। ২০২২ সালের শেষ নাগাদ পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করার পরিকল্পনা রয়েছে জার্মানির। সঙ্কট বিবেচনায় এর সময়সীমা বাড়ানো হতে পারে।

জ্বালানি অপচয় রোধ করতে নানামুখী ব্যবস্থা নিচ্ছে ফ্রান্স। যেসব দোকানে এয়ারকন্ডিশনিং চালু থাকে, তাদেরকে দোকানের দরজা বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। জ্বালানির অপচয় বন্ধ করতে নিয়ন বাতির ব্যবহার কমাতে বলা হয়েছে।

ইউরোপে গ্যাসের সংকট আগামী কয়েকটি শীত পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে সতর্ক করেছে শীর্ষ জ্বালানি কোম্পাানি শেল। বেলজিয়ামের জ্বালানিমন্ত্রী তিনে ভ্যান দের স্ট্রেটেন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন আগামী পাঁচ থেকে ১০টি শীতকাল নিয়ে।

ইউরোপ এখন পকেটভর্তি টাকা নিয়ে ঘুরছে। হন্যে হয়ে খুঁজছে বাঘের দুধ।

শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ : সাংবাদিক, লেখক

[email protected]

পূর্বপশ্চিম- এনই

শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ,ইউরোপ
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close