• শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ফের স্যাংশন জুজু: অস্থিরতার ঝাড়ফুঁক

প্রকাশ:  ২৩ নভেম্বর ২০২২, ১৯:০৯ | আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২২, ২১:০৬
মোস্তফা কামাল

সরকারি মহল থেকে আগামীকাল আটা বা চাল, তেল বা ডালের দাম কমবে বলে আশ্বাস দেয়া মাত্র আজই সেই পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দেয়ার এক অপখেলা জমেছে। একাজে কোমর বেঁধে তৎপর চক্রটি অদেখা হলেও অজানা নয়। এরা পেয়ে বসেছে পরিস্থিতিকে। সিন্ডিকেটের মতো সুন্দর নামে ডাকা চক্রটি অধরাই থেকে যাচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেয়া পদক্ষেপকে ভুল প্রমাণ করার এজেন্ডায় অবিরাম এগিয়ে চলছে এরা।

বিশ্বজুড়ে করোনার তাণ্ডব শেষে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর জেরে বিশ্ববাজার তোলপাড়, মন্দা। দুর্ভিক্ষের রাঙা চাহনি। এ থেকে অভয় দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশকে দুর্ভিক্ষে পাবে না। প্রধানমন্ত্রীর এ আশাবাদকে ভুল প্রমাণ করা দায়িত্ব হয়ে পড়েছে চক্রটির। দুনিয়াময় সম্ভাব্য খাদ্য সংকটের তাপ যেন বাংলাদেশে কম পড়ে, এ জন্য সাশ্রয়ী-সঞ্চয়ী হতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানকেও অপব্যাখ্যায় ভরিয়ে দিচ্ছে তারা। মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়া তাদের হাল মিশন। এরই মধ্যে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হওয়ার কোনো শঙ্কা নেই বলে ভরসা দিয়েছেন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) কান্ট্রি ডিরেক্টর ডমেনিকো স্কালপেল্লি।

মহলবিশেষের এখন গুরু দায়িত্ব এ ভরসা ও অভয়কে বানচাল করা। পারলে এ সপ্তাহেই দুর্ভিক্ষ নিশ্চিত করা। এদের তৎপরতায় ’৭৩-৭৪-এর নমুনা। কিছুদিন চলেছে বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনার আজব গুজব। গজবের মতো চাউর করা ওই গুজবে কুলাতে না পেরে এখন রটানো হচ্ছে, দেশে বহু মানুষের না খেয়ে মরার ভয়জাগানিয়া তথ্য। এসব বিষয়ে তেমন না জানলেও অনর্গল মুখপাণ্ডিত্য জাহিরের কিছু লোকের বাম্পার ফলন হয়েছে দেশে। আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি ছড়াতে পারঙ্গম এ সম্প্রদায়টি এগিয়ে যাচ্ছে ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা গায়েবি তথ্য কচলিয়ে।

নামজাদা কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ-গবেষক-বিশ্লেষকও শামিল এ নোংরা দৌড়ে। রিজার্ভ নিয়ে তাদের যাচ্ছেতাই কথামালা। জিডিপি, মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য মজুতসংক্রান্ত সরকারি হিসাবকে ভুল বলে প্রচারণা। প্রধানমন্ত্রীর সতর্কতাকে কখনো বলা হচ্ছে আতঙ্ক ছড়ানো। কখনো দাবি করা হচ্ছে, দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে কবেই? ওই প্রচারযন্ত্রীরাই আবার কিছুদিন আগে বলেছেন, সরকার বাস্তবতা গোপন রাখছে। তাদের এসব অভিযোগের কোনটা সঠিক- আগেরটা না পরেরটা? এর জবাব না দিয়ে সরকারের হিসাব, পরামর্শ, সতর্কতাকে ‘মানি না, মানি না’র ধুম। তারা কী মানেন না, কী হলে মানবেন- তাও বলেন না। আইএমএফ থেকে সরকার কেন ঋণ পায় না, কেন ঋণ নেয় না? আবার তাদেরই প্রশ্ন- কেন আইএমএফ থেকে ঋণ নিচ্ছে সরকার? আচানক প্রশ্নের সঙ্গে বিভ্রান্তিমূলক বাইটিংয়ে তারা মাতম তুলছেন একেক ইস্যুতে। গায়ের জোরে পাহাড় ঠেলার মতো প্রধানমন্ত্রীর সাহসী রাষ্ট্রনায়কোচিত মিতব্যয়ের আহ্বান ও সতর্কবার্তাকে নিয়ে যাচ্ছেন বটতলার রাজনীতির দিকে ট্রল-ব্যঙ্গের আইটেমে।

এ ধরনের তামাশা ও প্রোপাগান্ডার মধ্যে কিছুটা ’৭৩-৭৪ সালের দেশি-বিদেশি চক্রান্তের নমুনা বিদ্যমান। যা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে কলঙ্কিত করার উদ্দেশ্যে গণমাধ্যমের ওপর ভর করে। তৈরি হয়েছিল বাসন্তী নাটকও। যুদ্ধকালে পাক-হানাদাররা এ দেশের মানুষকে ভাতে মারার ‘পোড়া মাটি নীতি’তে মজুতকৃত বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য নষ্ট করেছে। যুদ্ধকালে অনেক কৃষিজমি অনাবাদি থেকে যায়। তার ওপর বাংলাদেশ তখন খাদ্যে স্বনির্ভর ছিল না। ঘাটতি পূরণে প্রতি বছর ৩০-৪০ লাখ টন খাদ্য আমদানি করতে হতো। উপরন্তু ভয়াবহ বন্যায় তলিয়ে যায় দেশের বিরাট অংশ। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আনা খাদ্য যেন সময়মতো জনগণের হাতে না পৌঁছে সেই অপচেষ্টাও চলে। দেশি লুটেরা ও ঘাপটি মেরে প্রাণে বেঁচে থাকা রাজনীতিকদের সিন্ডিকেটিংয়ে বিদেশি কিছু শক্তি তখন চুটিয়ে ফুড পলিটিক্স করেছে। বাজার থেকে চালসহ বিভিন্ন পণ্য কিনে নষ্ট পর্যন্ত করেছে। সেই অপরাজনীতির রিমেক আবারো লক্ষণীয়।

২০২৩ সালে বিশ্বে ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা-এফএও প্রধান ডেভিড বিস্মের মতে, খাবারের অভাব এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শুধু দুর্ভিক্ষই হবে তা নয়, বরং এর জেরে বিভিন্ন দেশে বৈষম্য ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, ইউক্রেন বিশ্বের ৪০ কোটি মানুষের খাদ্য জোগায় অথচ যুদ্ধের কারণে সেখান থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানি প্রায় পুরোটাই বন্ধ। রাশিয়া দ্বিতীয় বৃহত্তম সার রপ্তানিকারী এবং অন্যতম বড় শস্য উৎপাদক, কিন্তু পশ্চিমা দুনিয়ার নিষেধাজ্ঞার জেরে বিশ্ববাজারে তাদের পণ্য ঠিকমতো আসছে না। সার রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে বৃহত্তম উৎপাদক চীন। ফলে অন্যান্য দেশে শস্য উৎপাদন মার খাচ্ছে। আবার ভারতসহ বিভিন্ন দেশে অতিরিক্ত গরম এবং বৃষ্টির অভাবে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন।

জাতিসংঘ বা কোনো সংস্থার আভাসের আগ থেকেই বাংলাদেশকে সতর্কতার আওতায় এনেছে সরকার। আগামী বছরটিকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে সরকার। সেই দৃষ্টে মন্ত্রিসভাকে এক গুচ্ছ নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কর্মতৎপরতায় বোঝা যায় সরকার এ ব্যাপারে বেশ সতর্ক। সেই সুযোগ এবার দিতে চায় না। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষি খাতের জন্য এরই মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৪ শতাংশ সুদে কৃষকরা এই তহবিল থেকে ঋণ নিতে পারবেন। ৩ মাস গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ ১৮ মাসের ঋণ নেয়া যাবে এ তহবিল থেকে। এই তহবিল থেকে কৃষকরা ঋণ নিয়ে ধান, মাছ, শাকসবজি, ফল ও ফুল চাষ করতে পারবেন। প্রাণিসম্পদ খাতের আওতায় পোল্ট্রি ও দুগ্ধ উৎপাদনের জন্য ঋণ নেয়া যাবে। ক্ষুদ্র প্রান্তিক ও বর্গা চাষিরা এককভাবে জামানতবিহীন সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন। এই তহবিলের মেয়াদ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। যার মূল লক্ষ্য নিজস্ব উৎপাদন বাড়ানো। প্রধানমন্ত্রী চান এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে। স্থানীয় প্রশাসনকে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন খুঁজে খুঁজে অনাবাদি জমি বের করে চাষের আওতায় আনার।

প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তুতি ও পদক্ষেপের সাফল্য ভবিষ্যৎনির্ভর। কিন্তু‘ গুজব-চক্রান্তের ঢালপালা যেভাবে বিস্তার হচ্ছে, তাতে শঙ্কা না জেগে পারে না। একদিকে স্নায়ুযুদ্ধের জেরে গোটা বিশ্বে খাঁখাঁ দশা। খাদ্য সংকটসহ দুর্যোগকে ইস্যু করে কয়েকটি দেশে চলছে সরকার উৎখাতের আন্দোলন। তার ওপর এদেশে আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক, বৈশ্বিক ও স্থানীয় নানা ঝক্কি-যন্ত্রণা। বাংলাদেশে এর মাত্রা তুলনামূলক বেশি। নির্বাচনকে টার্গেট করে দেশে চলমান উত্তেজনার মধ্যে দেশি-বিদেশি অনেক সমীকরণের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত, ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাংলাদেশি প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দেশের ঢাকার কূটনীতিকরা বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন খোলামেলা। যার কিছু কিছু অতিকথনের পর্যায়ে। এর ধারাবাহিকতায় রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন জাপানের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। আবার তিনিই বলেছেন, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ জয়ে বাংলাদেশের সক্ষমতা বেশি। কথা প্রসঙ্গে বাংলাদেশে তার ৩ বছরের মধুর সময়ের কথা উল্লেখ করে মেট্রোরেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প, বিমানবন্দর সম্প্রসারণসহ বেশ কিছু প্রকল্পে মুগ্ধতার কথা জানান। বিদায়ের আগে, এত ভালো কথার বিপরীতে নির্বাচন প্রশ্নে বোমা ফাটিয়েছেন কথা কম, কাজ বেশির জাপানি রাষ্ট্রদূত নাওকি।

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দূতাবাসে দেশের রাজনীতিকদের ধরনা দেয়া বেড়েছে। বিভিন্ন দূতাবাস ও দাতা সংস্থার কাছে চিঠি দাখিলও বেড়েছে। সেখানে থাকছে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনেক কথা। এ সুযোগটি নিচ্ছে দূতাবাসগুলো। বিদেশে লবিংয়ের ঝাঁজও বাড়বাড়ন্ত। তার ওপর ১০ ডিসেম্বর সামনে রেখে বাড়তি উত্তেজনা। সেদিন ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ কর্মসূচি। দিনটি শনিবার। এই শনির মধ্যেই ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর আচমকা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাবের ওপর। যাদের অস্ত্র-প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় লজিস্টিক যুক্তরাষ্ট্রেরই দেওয়া। ওই স্যাংশনের উল্লাসে বিএনপিসহ বাংলাদেশের কয়েকটি মহল উল্লসিত। তারা একে তাদের আন্দোলনের সাফল্য ভাবছে। সরকার থেকেও বলার চেষ্টা হয়েছে এর পেছনে লবিংয়ে টাকার বস্তা ঢালা হয়েছে বলে। এ নিয়ে নিষ্পত্তিহীন বাকযুদ্ধ চলেছে দেশে।

অস্থিরতা-নৈরাজ্যসহ নানা অঘটনে সামনে এ ধরনের আরো কোনো নিষেধাজ্ঞার আয়োজনের গুজব-গুঞ্জন ঘুরছে। বিদেশি কয়েকটি রাষ্ট্রের কূটনীতিকদের অতি তৎপরতা এবং ডিসেম্বরের ১০ তারিখের পর আর প্রধানমন্ত্রীর কথায় দেশ চলবে না বলে হুংকারের সঙ্গে এ জুজুর একটা খুচরা বাজার কিন্তু‘ তৈরি হয়েছে। তা যুক্তি ও বাস্তবতায় একদম খাটে না। কিন্তু এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের দূতাবাস, রাষ্ট্রদূত থাকার পরও যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে ওই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এখনো রহস্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মধ্যে মন্দের মধ্যে ভালো খবর হচ্ছে, ১০ তারিখে বিএনপি কেবল তাদের আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি দেবে বলে জানিয়েছে। কোনো সহিংসতা বা ভিন্ন কিছু না করার কথাও দিয়েছে। এত দিন সরকারকে ফেলে দেয়া, সরকার পালাবার পথ পাবে না, ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়- এ ধরনের কথা থেকে সরে এসেছে দলটি। এটি তাদের মনের কথা না কোনো চিকন কৌশল? তাও প্রশ্নবিদ্ধ।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সূত্র: ভোরের কাগজ

মতামত,খোলামত
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close