• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

“কার সাথে পর্দায় যেতে হয়, কার সাথে শয্যায়”

প্রকাশ:  ২৮ অক্টোবর ২০২৩, ০৫:৫৮
সৈয়দ বোরহান কবীর

আজ (২৮ অক্টোবর) ঢাকায় কি হতে যাচ্ছে। আজ কিছু না হলেও রাজনীতিতে যে দুর্যোগের ঘনঘটা চলছে তা সহসা কাটবে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ পর্যন্ত হবে কিনা, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়বে। হয়তো দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও সহিংস হয়ে উঠবে। চারদিকে অজানা আতঙ্ক। গত ২৬ অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ‘নির্বাচনের কাঙ্খিত এবং প্রত্যাশিত পরিবেশ এখনও হয়নি।’ বিএনপি এবং জামায়াতের ঘোষিত মহাসমাবেশের ৪৮ ঘণ্টা আগে সিইসির এধরনের বক্তব্য কেন? ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের আগে বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য একটি। এর আগের দিন ২৫ অক্টোবর প্রগতি লাইফ ইন্সুরেন্স এর চেয়ারম্যান সৈয়দ আলতাফ হোসেনের গুলশানের বাসায় এক ‘রহস্যময়’ নৈশভোজ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের সঙ্গে ডিনার করেছেন বিএনপির বেশ ক’জন নেতা। মার্কিন রাষ্ট্রদূত এখন মোটামুটি বিএনপির প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। বিএনপির জন্য তার দৌড়ঝাপ কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সীমা ইতোমধ্যেই লঙ্ঘন করেছে। বিএনপির সমাবেশ নিয়ে উৎকণ্ঠায় তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছেও ছুটে গিয়েছিলেন। সময় যত যাচ্ছে বিএনপির প্রতি তার ভালোবাসার প্রবল আকর্ষণ বাড়ছে। কাজেই বিএনপির মহাসমাবেশের আগে দলের নেতাদের চাঙ্গা করতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নৈশভোজে মিলিত হবেন, এতে অবাক হবার কিছু নেই। পিটার হাসের সাথে বিএনপির প্রণয় এখন আর পরকীয়া নয়, প্রকাশ্য বাগদত্তার মতো। এরকম নৈশভোজের মধ্যে যদি বিএনপির অঘোষিত উপদেষ্টা নেতাদের টোটকা পরামর্শ দেন, তাহলে অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু অবাক হবার ব্যাপার ঘটেছে, ঐ রহস্যময় নৈশভোজে আওয়ামী লীগের একজন মন্ত্রীর উপস্থিতি নিয়ে। সাইফুজ্জামান চৌধুরী, ভূমি মন্ত্রী। আওয়ামী পরিবারের সন্তান। তার পিতা আক্তারুজ্জামান চৌধুরী ৭৫ পরবর্তী কঠিন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে উচিয়ে রেখেছিলেন। ক্লিন ইমেজের মন্ত্রী হিসেবে তার সুখ্যাতি রয়েছে। চট্টগ্রামের রাজনীতি এবং নিজস্ব মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিয়েই তিনি ব্যস্ত থাকেন। জাতীয় রাজনীতিতে তাকে খুব একটা সরব দেখা যায় না। বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কেন তিনি নৈশভোজে মিলিত হলেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে নানা কৌতুহল। যদিও তিনি এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন ‘ঘনিষ্ট বন্ধুর দাওয়াত গিয়ে’ ‘রাজনৈতিক আলোচনা করেননি’ মর্মে বিবৃতি দিয়েছেন। ঐ নৈশভোজে ভূমিমন্ত্রী, মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং কয়েকজন বিদেশী কূটনৈতিক ছাড়া বাকি সবাই বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আলতাফ হোসেনের দাওয়াতে বিদেশী কূটনীতিকদের মধ্যে পিটার ডি হাস ছাড়া ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সিঙ্গাপুরের কনস্যুলার, সিঙ্গাপুর দূতাবাসের ভাইস কনস্যুলার, মার্কিন দূতাবাসের পলিটিক্যাল কাউন্সিলর। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে নেতা, পাতি নেতারা সেখানে আপ্যায়িত হয়েছেন। এটা স্রেফ একটা সামাজিক অনুষ্ঠান, এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। অনুষ্ঠানে বিএনপির নেতাদের ভিড়ের মধ্যে একমাত্র আওয়ামী লীগের মন্ত্রীর উপস্থিতি দৃষ্টিকটু লেগেছে। এর মাধ্যমে নানা প্রশ্ন এবং রহস্যের ডালপালা মেলারও সুযোগ তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন উঠতেই পারে, আওয়ামী লীগ বিএনপির নেতাদের মধ্যে কি সামাজিকতাও থাকবে না। বিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠানেও কি তাদের দেখা সাক্ষাৎ হতে পারে না? কেন থাকবে না? আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতারা হরহামেশাই এক সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যান। ঠাট্টা তামাশাও করেন। বিভিন্ন দূতাবাসের দাওয়াতে তাদের দেখা সাক্ষাৎ হওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনা। সংবাদ পত্রের বর্ষপূর্তি কিংবা টিভি চ্যানেলের জন্মদিনেও তারা পাশাপাশি বসে অথবা দাঁড়িয়ে কেক কাটেন, গল্প করেন। এসবে দোষের কিছু নেই। বরং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এরকম ভূতুড়ে নৈশভোজে আওয়ামী লীগের আর কেউ দাওয়াত পেলেন না বা গেলেন না একমাত্র ভূমিমন্ত্রী ছাড়া, তা কি করে হয়? বিশেষ করে সময়টা এখন ভালো নয়। আর পিটার হাস আর বিএনপি নেতারা একত্রিত হলেই ষড়যন্ত্রের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এরকম বাস্তবতায় ভূমিমন্ত্রী বিএনপির ডেরায় কেন নৈশভোজে গেলেন তা নিয়ে বহুপ্রশ্ন উঠতেই পারে। অতীতেও রাজনীতিতে এরকম নানা তিক্ত আমন্ত্রণ অভিজ্ঞতা আওয়ামী লীগের হয়েছে।

৮১ সালে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এরপরপরই আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, ৭৫ এর খুনীরা যদি কোন অনুষ্ঠানে থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগ সেই অনুষ্ঠান বর্জন করবে। এরপর বহুদূতাবাসে কিংবা দাওয়াতে গিয়েও আওয়ামী লীগের নেতারা বর্জন করেছেন। ৯০ এর দশকের শেষ দিকে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নেয় যে, যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের কোন সদস্য উপস্থিত থাকলে আওয়ামী লীগ সেই অনুষ্ঠানে যাবে না। এই নিয়মগুলো এখনও আছে। এসব নিয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতারা অনেক সময়ই বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। তাদের আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভূমিমন্ত্রী যখন এই নৈশভোজে যান, তার কয়েকদিন আগেই আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নীতিনির্ধারণী বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। তিনি বলছেন, ‘নির্বাচন বানচাল করে অনির্বাচিত কাউকে ক্ষমতায় আনার ষড়যন্ত্র চলছে।’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘ঘরে ঘরে মোশতাক সতর্ক থাকবে হবে।’ আওয়ামী লীগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাইরের শক্তি আওয়ামী লীগকে কখনো পরাজিত করতে পারেনি। ৭৫ এর ১৫ আগস্ট ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হতো না যদি খুনী মোশতাক বিশ্বাসঘাতকতা না করতো। আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের কাছেই। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উপর দিয়ে হেটে বঙ্গভবনে খুনীর মোশতাকের নেতৃত্বে শপথ নিয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতারা। আবদুর রাজ্জাকের বাকশাল কিংবা ৯১ এর নির্বাচনে অন্তকলহ সবই আওয়ামী লীগকে পরাজিত করেছে। ২০০৭ সালের এক-এগারোর সময় আওয়ামী লীগের সংস্কারপন্থীদের কারণেই শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তারাই রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন। এখন বিএনপি এবং জামায়াত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলন করছে। আজ বিএনপির ঢাকায় মহাসমাবেশ। এখান থেকে বিএনপি আন্দোলনের মহাযাত্রা করতে চায়। বিএনপি এখন আগের চেয়ে অনেক আত্মবিশ্বাসী। দলটির নেতাদের কথাবার্তায় হুমকি আর দম্ভ। বিএনপি যে নিজের শক্তিতে বলীয়ান এমনটি নয়। বিএনপির শক্তির প্রধান উৎস বারিধারা। তাদের পরামর্শেই বিএনপি কর্মসূচির ডালি সাজিয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায় না। তারা আওয়ামী লীগকে হটিয়ে অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনতে চায়। এজন্যই পশ্চিমা দূতাবাসগুলো এবং সুশীল সমাজ এক জোট হয়ে বিএনপিকে মদদ দিচ্ছে, উৎসাহ দিচ্ছে। একটি অনির্বাচিত সরকারকে আবার ক্ষমতায় বসানোর নীলনকশার বাস্তবায়ন চলছে নীরবে। এই ষড়যন্ত্রকারীদের শক্তিতেই ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি কিছুটা হলেও প্রাণবন্ত। কিন্তু বিএনপি বা পশ্চিমা দেশ যৌথভাবে ষড়যন্ত্র করলেও আওয়ামী লীগকে হারাতে পারবে না। অন্তত ইতিহাস তাই বলে। আর এজন্য দরকার আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকা ঘাপটি মেরে থাকা মোশতাকদের তৎপরতা। আওয়ামী লীগের বিভক্তি এবং বিশ্বাসঘাতকতা। সেই তৎপরতার কিছু আলামত আমরা ইতিমধ্যেই পেতে শুরু করেছি। একজন সাবেক বিচারপতি আদালতের কার্যক্রমে যে ভাষায় কথা বলেছেন, বিরোধী রাজনীতিবিদরা রাজপথের মেঠো বক্তৃতাতেও এরকম ভাষা ব্যবহার করেন না। একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. ইউনূস ইস্যুতে যে নাটক করলেন, তা অবিশ্বাস্য। অথচ আওয়ামী লীগই তাকে ডেপুুটি অ্যাটর্নি জেনারেল পদে নিয়োগ দিয়েছিল। সচিবালয়ে কানপাতলেই নব্য মোশতাকের আওয়াজ এখন শোনা যায়। এই সরকারের আশীর্বাদে তরতর করে পদোন্নতি পাওয়া আমলারাই এখন সরকারের বড় সমালোচক। আওয়ামী লীগের ভেতর মন্ত্রী এবং বড় নেতারা যারা লাগামহীন কথাবার্তা বলে দল এবং সরকারকে বিব্রত করেন, তারা কার স্বার্থ দেখছেন? যে সব দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অযোগ্যতায়, গাফিলতিতে এবং ইচ্ছাকৃত ভুলে অর্থনীতি সংকটে, তারা কি সরকারের ভালো চান? দ্রব্যমূল্যের বাজারকে অস্থির করে যারা হাবা হাসমতের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, তারা কতটা অযোগ্য আর কতটা ষড়যন্ত্রের অংশ কে বলবে? সরকারের সাথে চাটুকারিতা করে যারা ব্যাংকগুলো লুট করে নিচ্ছে তারা কি সরকারের শুভাকাঙ্খী? আওয়ামী লীগের সুসময়ে আপনজন সেজে যারা বিদেশে অর্থ পাচার করে রিজার্ভ খালি করে দিয়েছে, তারা কি দুঃসময়ে পাশে থাকবে? প্রশ্নগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতার এই সময়ে খুব বড় হয়ে সামনে আসে। এসময়ে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা আছেন, তাদের দায়িত্বশীল আচরণ এবং সংযত কথাবার্তা অত্যন্ত জরুরী। বেফাঁস কথা, অসতর্ক দাওয়াত গ্রহণ, কিংবা বেসামাল আচরণ একজন মন্ত্রী বা নেতার নিজের ক্ষতিই শুধু করে না, আওয়ামী লীগ সরকারকেও বিব্রত করে।

গত ৫ বছরে বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, গুরুত্বপূর্ণ নেতা দৃষ্টিকটু আচরণ করেছেন। বিরোধীদলকে মুখরোচক আলোচনার খোরাক দিয়েছেন। পাপিয়া কিংবা শাহেদের সাথে যারা ছবি তুলেছেন, তাদের ‘নির্দোষ সেলফি’তে সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে আওয়ামী লীগের। নায়িকার সঙ্গে অশালীন কথা বলে এক প্রতিমন্ত্রী চাকরি হারিয়েছেন বটে, কিন্তু তা বিরোধীদের জন্য ভালো অস্ত্র হয়েছে। এজন্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সংযত আচরণ সবক্ষেত্রে জরুরী। বিশেষ করে সরকারের শেষ সময়ে ছোট ভুল বড় সর্বনাশের কারণ হতে পারে। একটা দেয়াশলাইয়ের কাঠি একটি বড় অগ্নিকান্ড ঘটাতে পারে। যারা মন্ত্রী হয়েছেন, বড় বড় পদ-পদবী পেয়েছেন, আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন, এদের দায়িত্ব এখন আওয়ামী লীগকে কিছু দেয়ার। কিছু দিতে না পারেন, আপনার জন্য যেন আওয়ামী লীগ এবং সরকারের কোন ক্ষতি না হয়, সেটা খেয়াল অন্তত রাখুন। দেশের প্রধান কবি শামসুর রাহমান সম্পর্কে প্রথা বিরোধী সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ একদা একটি মন্তব্য করেছিলেন। এক নায়িকার সঙ্গে বাংলাদেশ টেলিভিশনে এক অনুষ্ঠানে কথা বলেছিলেন শামসুর রহমান। এটা দেখে ড. আজাদ মন্তব্য করেছিলেন ‘শামসুর রাহমান জানেন না কার সাথে পর্দায় যেতে হয়, কার সাথে শয্যায়।’ ড. হুমায়ুন আজাদ যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে নিশ্চয়ই বলতেন ‘মন্ত্রীরা জানেনা কার সাথে সেলফি তুলতে হয়, আর কার বাসায় কাদের সাথে দাওয়াত খেতে যাওয়া যায়।’

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

সৈয়দ বোরহান কবীর
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close