• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

রাজনীতিকে দূষণ মুক্ত করার এখনই সময়

প্রকাশ:  ২৪ নভেম্বর ২০২৩, ২৩:১৭
সৈয়দ বোরহান কবীর

সম্পর্কিত খবর

    যেকোনো সংকট সম্ভাবনার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের চালমান রাজনৈতিক সংকটও এক অসাধারণ সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে। রাজনীতিকে আবর্জনা মুক্ত এবং দূষণ মুক্ত করার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭৫ এর পর থেকে দূষিত, দূর্গন্ধময় হতে হতে এখন তাতে পচন ধরেছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে সর্বত্র। রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তরুণরা। সাধারণ মানুষ মনে করে, রাজনীতি হলো শর্টকাটে নির্বিঘ্নে লুটপাটের সহজ পথ। রাজনীতি এখন প্রধান ব্যবসা। দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, দূর্বৃত্ত, অর্থপাচারকারীদের আশ্রয় স্থলে পরিণত হয়েছে রাজনীতি। জিয়াউর রহমান ঘোষণা দিয়ে রাজনীতিকে ‘ডিফিকাল্ট’ করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতিবিদদের জন্য সত্যিই তিনি রাজনীতিকে ডিফিকাল্ট করেছেন। ভাড়াটেরা রাজনৈতিক দলগুলোকে রীতিমতো দখল করেছে, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।

    ৭৫ এর আগস্ট ট্রাজেডি বাংলাদেশের রাজনীতিকে দুটি ধারায় বিভক্ত করেছে। একটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ধারা। অন্যটি স্বাধীনতা বিরোধী ধারা। পৃথিবীর কোন দেশের রাজনৈতিক দল গুলো মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে বিভক্ত থাকে না। একটি দেশের অস্তিত্ব, অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল থাকতে পারে না। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের আদর্শগত বিরোধ আছে, থাকবে। কিন্তু মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে তারা একমত থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট কিংবা রিপাবলিক যারাই ক্ষমতায় থাকুক, দেশটির ইসরায়েল নীতির পরিবর্তন হয় না। ভারতে কংগ্রেস-বিজেপির মধ্যে মত পার্থক্য অনেক। কিন্তু কানাডা প্রশ্নে তারা অভিন্ন। কাশ্মীর ইস্যুতেও তাদের মৌলিক বিরোধ নেই। বিজেপি-কংগ্রেস উভয় দলই পাকিস্তানকে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র মনে করে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি ভয়ংকর ভাবে বিভক্ত। এই দেশের রাজনীতি এমন যে, একটি বড় এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল জাতির পিতাকে অস্বীকার করে। ৭৫ এর ১৫ আগস্টকে উৎসবের দিন বানিয়ে কুৎসিত উৎসব করে। এদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস দুভাবে ব্যাখ্যা করে। ৭১ এ যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল, সেই রাজাকার, আল-বদর যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসিত করে একটি দল। স্বাধীনতা বিরোধী ধারাকে বিকশিত করাই যেন একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য। মৌলিক প্রশ্নে এই বিভক্তি রাজনীতিকে যেমন জটিল করেছে, তেমনি দেশকেও করেছে বিভক্ত।

    বাংলাদেশে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকবে। আদর্শের পার্থক্য থাকবে, মতভেদ থাকবে। কিন্তু মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে সবাই থাকবে একমত। জাতির পিতাকে নিয়ে কেউ বিতর্ক করবে না। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কেউ অবস্থান নেবে না। স্বাধীনতা বিরোধীদের কেউ আশ্রয় প্রশ্রয় দেবে না। এই মৌলিক প্রশ্নে একমত থেকে নানা মত ও পথের রাজনীতি দেশের গণতন্ত্রকে বিকশিত করবে। এটাই আমাদের ঐক্যের সূত্র। কিন্তু ৭৫ এর পর জিয়ার বিভাজনের রাজনীতি, স্বাধীনতা বিরোধীদের কেবল পুনর্বাসিত করেনি, শক্তিশালী করেছে। এই ধারার মূল দল বিএনপি।

    বিএনপি নামের সংগঠনটি যতদিন থাকবে, ততদিন ‘বাংলাদেশ’ এক হতে পারবে না। দেশের মৌলিক প্রশ্নে ঐক্যমত ছাড়া একটি জাতি কখনো তার অভীষ্ট অর্জন করতে পারে না। ২০০৮ এর নির্বাচনে এদেশের জনগণ ঐক্যের পক্ষে রায় দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়েছিল। ঐ নির্বাচনের পর থেকে আস্তে আস্তে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে হাটছে বাংলাদেশ। বিভাজনের দেয়াল উপড়ে ফেলছে জনগণ। যুদ্ধপরাধীদের বিচার হয়েছে। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে এখন আর কেক কেটে ভুয়া জন্মদিন পালনের বিভৎস উৎসব হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে ‘বিএনপি’ নামের বিষফোঁড়া যতদিন থাকবে ততদিন ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে আমরা দাঁড়াতে পারবো না। গত ১৫ বছর ভুল রাজনীতির চোরাগলিতে গিয়ে বিএনপি এখন মুমূর্ষু। ২৮ অক্টোবর আত্মঘাতি আন্দোলন দলটিকে আইসিইউতে নিয়ে গেছে। এখন অবরোধ-হরতালের মতো গণবিরোধী কর্মসূচির কারণে বিএনপি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। কিছু অবুঝ বিভ্রান্ত কর্মী সমর্থকদের কারণে দলটি এখন লাইফ সাপোর্টে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি আওয়ামী লীগকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু বিএনপির সিদ্ধান্ত বুমেরাং হয়ে গেছে। নিজেদের খোঁড়া গর্তে নিজেরাই পড়েছে। বিএনপি ভেবেছিল, তারা নির্বাচন না করলেই বোধ হয় একতরফা নির্বাচন হবে। ২০১৪’র নির্বাচনের মতো ঘটনা ঘটবে। কিন্তু এবার তা হচ্ছে না। বিএনপিকে ছাড়াই দেশে সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনী আমেজ। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, যুক্তফ্রন্ট সহ নানা দল এখন নির্বাচনী মাঠে। শরিকরাও এখন বিএনপিকে গুড বাই জানিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। এর ফলে দেশের রাজনীতির বিষাক্ত ধারাকে উপড়ে ফেলার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিভক্তির দেয়াল ভেঙ্গে ফেলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এবার এখন পর্যন্ত যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের মধ্যে চমৎকার একটি মিল লক্ষণীয়। সবাই অন্তত মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে। সবাই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকার করে। বিএনপি এই নির্বাচনে না আসায় বাংলাদেশের একটা বড় লাভ হলো। এর ফলে মূলধারা থেকে ছিটকে গেল বিএনপি। বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারা পাপ মুক্ত হলো। এটাই হওয়া উচিত রাজনীতির ধারা। দেশের মৌলিক প্রশ্নে অভিন্ন মতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এদেশকে নিয়ে যাবে নতুন উচ্চতায়।

    তবে, রাজনীতি কুলুষ মুক্ত হবে তখনই যখন আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ। এই নির্বাচন সুষ্ঠু এবং সুন্দর হওয়া বাংলাদেশের জন্য জরুরী। এই নির্বাচনও যদি ২০১৪ কিংবা ২০১৮ সালের মতো প্রশ্নবিদ্ধ হয় তাহলে তা হবে এদেশের রাজনীতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। এর ফলে আবার স্বাধীনতা বিরোধী ধারা শক্তিশালী হবে। পুনর্জন্ম হবে বিএনপির। রাজনীতির শেষ আশার প্রদীপ টুকুও নিভে যাবে। জয়-পরাজয়ের চেয়ে এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু এবং উৎসব মুখর হওয়া জরুরী। একটি ভালো নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভক্তি শেকড় উপড়ে ফেলতে পারে। বিএনপির কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে পারে।

    আরেকটি ক্ষেত্রে এবারের নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। ২৮ অক্টোবরের পর মুখ থুবড়ে পড়ে বিএনপির রাজনীতি। নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচন নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্ব কেটে যাবে। এখন সারা দেশে সৃষ্টি হয়েছে নির্বাচনী উত্তেজনা। এবারের নির্বাচনে শুরুতেই আওয়ামী লীগের পক্ষে একটি আবহ সৃষ্টি হয়েছে। নৌকার পক্ষে একটি জোয়ার উঠেছে। যে সব দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে তারা সবাই দ্বিতীয় হতে চায়। জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম সবাই প্রধান বিরোধী দল হতে চায়। আওয়ামী লীগ ছাড়া কোন দল নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করবে, এমনটি স্বপ্নেও ভাবে না। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অপ্রতিদ্বন্দ্বি। তাই রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ করার এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব আওয়ামী লীগের কাঁধে। ৭৫ এর পর রাজনীতিতে যে দূষণ তাতে আক্রান্ত হয়েছে আওয়ামী লীগও। অস্তিত্ব টিকে রাখার জন্য ভোটে জয়ী হতে আওয়ামী লীগকে অনেক আপোষ করতে হয়েছে। আদর্শের বাইরে লোকজনকে মনোনয়ন দিতে হয়েছে। দূর্বৃত্ত, লুটেরারা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করে হয়েছেন মন্ত্রী, এমপি। টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে দলের ভেতর বানের পানির মতো প্রবেশ করেছে হাইব্রিড, চাটুকার মতলববাজরা। ভাড়াটে রাজনীতিবিদদের অত্যাচার আওয়ামী লীগ অতিষ্ঠ। গত ১৫ বছরে ব্যাপক উন্নয়নের পরও আওয়ামী লীগের যা বদনাম তা এসব ব্যাংক লুটেরা, অর্থপাচারকারী দূর্বৃত্তদের কারণেই। গত কয়েক বছর ধরে শেখ হাসিনা সত্যিকারের ত্যাগী, পরীক্ষিতদের সামনে টেনে আনার চেষ্টা করেছেন। এদেরকে বিভিন্ন উপনির্বাচনে মনোনয়নও দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। এবারের মনোনয়নে বিতর্কিতদের বাদ দেয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটি একটি মহেন্দ্রক্ষণ। আওয়ামী লীগ যদি এসব অনুপ্রবেশকারীদের মনোনয়ন না দেয় তাহলে দেশ বাঁচবে, রাজনীতি রক্ষা পাবে। এই কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনই সময়। আওয়ামী লীগ কি পারবে?

    সৈয়দ বোরহান কবীর
    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close