• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

সন্তানদের রেসের ঘোড়া না বানিয়ে মানবিক মানুষ বানান।

প্রকাশ:  ১১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৯:৪৪
এবিএম জাকিরুল হক টিটন

প্রফেসর ডঃ তারেক শামসুর রেহমান এর নিঃসঙ্গ মৃত্যুর কথা নিশ্চয় আপনাদের মনে আছে? স্যার উত্তরা তাঁর নিজের বাসায় একা বেশ কয়েক দিন মৃত্যু অবস্থায় পড়ে ছিলেন। কারন তাঁর সন্তানরা স্ত্রী সহ বিদেশে অবস্থান করতেন। যা আমি আমার ফেসবুকে ঘটনাটি ঘটার সময় পোষ্ট করে ছিলাম। প্রফেসর ডঃ তারেক শামসুর রেহমানের মতো নিঃসঙ্গ করুণ মৃত্যু বাংলাদেশের অনেক বাবা মা'র জন্যই অপেক্ষা করছে বলে আমি মনে করি। আপনারা বিশ্বাস করেন বা না করেন, যার মধ্যে আমিও একজন হতে পারি।

বাংলাদেশের মিডল ক্লাস ফ্যামিলির প্রতিটা বাবা মা সন্তানকে এমন ভাবেই মানুষ করেন। বড় হও, ধনী হও, টাকা কামাও, স্ট্যাটাস বানাও, ক্যারিয়ার বানাও কথাগুলো জপ করতে করতে এই বাবা মা'রা সন্তানদের বলতে ভুলে যান, বাবা'রা এবার একটু থামো, ভালোবাসো ও মানবিক মানুষ হও। কেউ এমন বলে না। কেউ না। আর যখন নানান কষ্টে বাবা মায়েরা বলে, তখন সোনার সন্তানরা তা আর শুনতে চান না।

ছোটবেলা থেকেই এই ছেলে মেয়েদের রেসের ঘোড়া বানানোর প্রক্রিয়া চলতে থাকে। আদর, যত্ন, ভালোবাসার সাথে সাথে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়, তোমাকে কিন্তু "ওর" মতোই হতে হবে। না হতে পারলে কিন্তু আমাদের "মুখ" উজ্জ্বল হবে না।

ছেলে মেয়েও শুরু করে দৌড়। ক্যারিয়ারের জন্য দৌড়, স্ট্যাটাসের জন্য দৌড়, ওর মতো হওয়ার জন্য দৌড়, বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য দৌড়।

কেউ সে দৌড়ে জিতে, কেউ হারে। যে হারে তাকে বার বার মনে করিয়ে দেওয়া হয় তুমি পরাজিত, তুমি আমাদের মুখ উজ্জ্বল করতে পারো নাই। আর যে জিতে, তারে নিয়ে বাবা মা শুরু করে গর্ব। দেখেছো, আমার ঘোড়া কত সুন্দর দৌড়ায়? আমরা ঐ ঘোড়ারই সফল বাবা মা।

সমাজে মুখ উজ্জ্বল করার খেলা শেষ হয়। স্ট্যাটাসের খেলা শেষ হয়। ক্যারিয়ার ক্যারিয়ার খেলা শেষ হয়। আত্মীয়দের মধ্যেই জিতে যাওয়ার খেলাটাও শেষ হয়। বাবা মা'র বয়স হয়। বাবা মা এবার চায় তার বাজির ঘোড়া ঘরে ফিরুক। খেলা তো শেষ হলো, আর কত?

কিন্তু ততদিনে ঘোড়া একলা চলতে শিখে গেছে। ততদিনে ঘোড়াটা আরো জোরে দৌড়াতে শিখে গেছে, সেও এখন ক্যারিয়ার, স্ট্যাটাস, টাকার হিসাব করতে শিখে গেছে । সে দৌড়াতে শিখেছে, কিন্তু সে থামতে শেখেনি।

বাবা মা'র ভালোবাসা, মায়া, মততা দয়ার কথাবার্তা ঐ ঘোড়া সন্তানটি এখন আর বুঝতেই পারে না। বাবা মা'র ভালোবাসার কথা তার কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়। তাকে তো ছোটবেলা থেকে দৌড়ানো শেখানো হয়েছে, থামতে শেখানো তো হয়নি। তাকে ছোটবেলা থেকেই ক্যারিয়ারের অঙ্ক শেখানো হয়েছে, ভালোবাসার উত্তর তো শেখানো হয় নি।

একটা সময় গিয়ে এই বাবা মা'রা ঠিকই বুঝতে শুরু করেন, সন্তানের লুক্রেটিভ ক্যারিয়ারের চেয়ে সন্তানকে একটু ছুঁয়ে দেখা বেশি আনন্দের। ছেলেটার সাথে বিকেলে একটু চা খাওয়া অনেক বেশি মূল্যবান ও আনন্দের। আত্মীয় স্বজনের কাছে মুখ উজ্জ্বল করার চেয়ে,বিরাট ক্যারিয়ারিস্ট সন্তানের গর্ব করার চেয়ে, এক বিকেলে বারান্দায় বসে মেয়েটার মাথায় তেল দিয়ে দেওয়াটা বেশি আনন্দের। চুলে বেনি করে দেওয়াটা বেশি সুখের। সন্তানের দাদা, দাদী, নানা,নানী, চাচা,ফুপি,মামা, খালা, কাজিন সহ প্রিয় নিকট জনের চির বিদায়ের সময় যখন প্রিয় সন্তান কে পাশে না পায়, তখন বিলাপ করা ছাড়া আর কি বা করার থাকে। এটাই কি জীবন? এটাই কি আভিযাত্য? এর চেয়ে ঢের ভালো ছিলো যৌথ পরিবার। তারের মত সবাই জরিয়ে থাকা।

এক বুক ক্লান্তি নিয়ে কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন,

কেউ বলেনি,

ক্লান্ত পথিক,

দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও....

প্রিয় বাপ মা'রা, আপনাদের সন্তানেরা দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লান্ত। তাদের একটু থামতে বলুন। একটু জিরিয়ে নিতে বলুন। তাদের ঘোড়া বানায়েন না প্লিজ, যান্ত্রিক রোবট বানায়েন না প্লিজ। তাদের মানুষ বানান, মানবিক বানান। তাদের শুধু ক্যারিয়ার শেখাবেন না, শুধু স্ট্যাটাস আর টাকা শেখাবেন না, তাদের ভালোবাসতেও শেখান। মানবিক গুণাবলি শেখান।

এতে হয়তো আপনার ছেলে বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানী হতে পারবে না। হার্ভার্ড নাসা কাপাইতে পারবে না। সফলতার হিমালয় জয় করতে পারবে না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সে আপনার কথা বুঝবে। আপনার হাতটা ধরতে পারবে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনার খোঁজ নিবে, ওষুধটা খাইয়ে দিবে। বিশ্বাস করেন, নাসার বিজ্ঞানী সফল রোবট সন্তানের চেয়ে আপনার হাতে হাত রাখা মানবিক গুনাবলি সম্পূর্ণ মানুষ হওয়া সন্তান আপনার জন্য অনেক বেশি প্রয়োজন ও কাজের।

আপনার সন্তানকে বাজির ঘোড়া নয়, ভালোবাসার মানুষ বানান, মানবিক মানুষ বানান প্লিজ।

বিঃদ্রঃ অনেক ক্ষেত্রে বাবা মা উভয়ে এর জন্য অভিযুক্ত নাও হতে পারে। কোনো কোনো বাবা কিংবা মা অথবা বাবা মা উভয়েই এই নষ্ট, পচা- গলা, অধঃপতিত পুজিঁবাদী সমাজের অবস্থার ও লোভের স্বীকার হয় বলে আমি মনে করি।

সন্তান,রেসের ঘোড়া,মানবিক মানুষ
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close