• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় শিল্পী-সাহিত্যিকদের অবদান

প্রকাশ:  ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:০৭
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সে সময়ের ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির অভাবনীয় এবং নির্ভীক অবদানের কথা বর্তমান প্রজন্মেরও কমবেশি অনেকেই জানেন। ভারতের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের, সে দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের এবং সর্বোপরি জনগণের অবদানের কথাও মোটামুটি সবাই জানেন। কিন্তু ভারতের চলচ্চিত্র, সংগীত, অংকন শিল্পী এবং কবি-সাহিত্যিকদের মূল্যবান অবদানের কথা তেমন প্রচারিত হয়নি বলে এ সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণের ধারণা খুব সীমিত। অথচ তাদের অবদানও ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

আমি তখন লন্ডনে আইন শিক্ষার্থী এবং সেই সঙ্গে বিলেতভিত্তিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত এক ছাত্র। ২৫ মার্চ পাকিস্তানিদের দ্বারা গণহত্যা শুরু হওয়ার পর বেশ কয়েক সপ্তাহ আমরা পত্র-পত্রিকায় শুধু হতাহতের স্তূপের কথাই জানতাম, জানতাম বিভীষিকা এড়িয়ে ভারতগামী জনতার বিরতিহীন কাফেলার কথা। কোনো ভালো খবরই পাচ্ছিলাম না। নৈরাশ্য যে আমাদের প্রভাবিত করেনি তা নয়।

তারপরও ভাবতাম অন্ধকার ভেদ করে এক সময় আলো আবির্র্ভূত হবে। ঠিক সে সময়ে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি কলকাতা থেকে দুটি গান সাত সমুদ্র পেরিয়ে লন্ডনে পৌঁছালো। একটি ছিল অংশুমান রায়ের কণ্ঠে গাওয়া ‘শোন একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুরের কণ্ঠ স্বরের ধ্বনি...’, অন্যটি ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘মাগো ভাবনা কেন। ’ দুটি গানই লিখেছেন কিংবদন্তি গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার।

গান দুটি শোনার পর মনের জোর বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল এই ভেবে যে আজ হোক, কাল হোক, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক শাহরিয়ার কবিরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী, প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জব্বারের কণ্ঠে ‘শোন একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুরের কণ্ঠ স্বরের ধ্বনি...’ গানটি শোনার পর তিনি আর নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শরিক হওয়ার জন্য ওপার বাংলার পথে। এরপর আরও বহু গান বিলেতে আসতে থাকে যেমন শচিন দেব বর্মণের কিঞ্চিত ভাষা পরিবর্তিত গান, ‘বাজে টাক ঢুম টাক ঢুম বাজে, বাংলাদেশের ঢোল’, শ্যামল মিত্রের গাওয়া ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলিম’, ভূপেন হাজারিকার গান ‘বিস্তীর্ণ দু’পাড়ে’, ‘গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা’। পূর্বে মান্না দের একটি গানের কথা ছিল- “না না না, আজ রাতে আর যাত্রা শুনতে যাবো না’, সেই গানের ভাষা পাল্টিয়ে গাওয়া হয়েছিল ‘ইয়াহিয়া তুমি হত্যা যতই করো না’। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার দিনই গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কলকাতার বেতার কেন্দ্র থেকে গেয়েছিলেন তাঁর অমর সেই গান ‘বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে তোমার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলায়’।এটি স্বাধীনতার পরে হলেও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গোটা একাত্তুর সালে মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এপ্রিল মাসেই তিনি, তাঁর স্বামী শ্যামল গুপ্তসহ কলকাতার আরও কয়েকজন এবং বাংলাদেশের কজন শিল্পীর প্রচেষ্টা এবং উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, যেটি থেকে মূলত বাংলাদেশি শিল্পীরাই গান গাইতেন।

প্রাণ রক্ষার্থে বাংলাদেশ থেকে পাড়ি জমানোরা পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নিলে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, উৎপলা সেন প্রমুখ নামিদামি কণ্ঠশিল্পী প্রতিনিয়ত আশ্রয় শিবিরে গিয়ে আশ্রিতদের শুধু সাহসই জোগাতেন না, আর্থিকভাবে এবং খাবার প্রদান করে সহায়তা করতেন।

পশ্চিম বাংলার বাইরেও চলচ্চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, অংকনশিল্পী এবং কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে মানবতার তাগিদ বেড়ে গেলে তারাও উদ্যোগী হন বিভিন্নভাবে। সে সময়ে মহারাষ্ট্রের মুসলমান গভর্নর ইয়ার জং বাহাদুরের বিশেষ উদ্যোগে বোম্বাই শহরে জুন-জুলাই মাসে এক বিশাল অনুষ্ঠান করা হয়, যাতে বিখ্যাত কবি এবং গীতিকার কাইফি আজমি, তাঁর কন্যা জনপ্রিয় চলচ্চিত্রশিল্পী শাবানা আজমি, ওয়াহিদা রহমান, মোহাম্মদ রফি, দিলীপ কুমারের মতো বরেণ্য চলচ্চিত্র এবং কণ্ঠশিল্পী ছাড়াও বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রশিল্পী নার্গিস দত্ত।

সমুদয় অর্থ বাংলাদেশ তহবিলে দেওয়া হয়েছিল। বোম্বের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটি বিশাল কনসার্ট আয়োজন করে কয়েক লাখ টাকা উপার্জন করে তা বাংলাদেশ সরকারের ফান্ডে দিয়েছিল। স্বনামধন্য চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক তৈরি করেছিলেন ‘দুর্বার গতি পদ্মা’ ছবিটি, যার থেকে অর্জিত অর্থও বাংলাদেশ তহবিলে দেওয়া হয়েছিল। এপ্রিল মাসেই ঔপন্যাসিক তারা শংকর বন্দ্যোপাধ্যায় ও দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতে শরণার্থী বাংলাদেশের শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন, গঠন করেন মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক সমিতি। এতে সংযুক্ত ছিলেন বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়, অন্নদা শংকর রায় প্রমুখ। মে মাসে ড. এ আর মল্লিক এবং জহির রায়হান গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী সংগ্রাম পরিষদ, যার একটি অংশ ছিল ‘কালচারাল স্কোয়াড’। শাহরিয়ার কবির ছাড়াও এতে যুক্ত ছিলেন খান সারওয়ার মোরশিদ, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আলমগীর কবির, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলী যাকের প্রমুখ। এ সংস্থা গোটা ভারতে বহু অনুষ্ঠান করেছিল যাতে ভারতের খ্যাতনামা শিল্পী-সাহিত্যিকরা অংশ নিয়েছিলেন। একই সময় সলিল চৌধুরী লতা মঙ্গেশকরকে বাংলাদেশে গণহত্যার কথা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলে লতা তাৎক্ষণিকভাবে এক লাখ টাকার চেক (যা বর্তমান বাজারে এক কোটি টাকার কম নয়) লিখে দেন এবং একাত্তর সালে তাঁর সব গান থেকে পাওয়া রয়্যালিটি বাংলাদেশ তহবিলে প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা বাস্তবায়িত করেন। সে সময়ে কবি কাইফি আজমি হিন্দিতে একটি কবিতা লিখেছেন যা বাংলায় তরজমা করলে হয়- ‘আর কত মানুষ হত্যা করলে তুমি সুখ পাবে। ’ সেই সময় দিল্লির একটি স্থির চিত্র থেকে জানা যায় যে, মাদার ইন্ডিয়া ছবির অভিনেতা (পরে ভারতের মন্ত্রী) নার্গিস দত্তের স্বামী সুনীল দত্ত বঙ্গবন্ধুর বিশালাকার ছবি নিয়ে বহুদিন দিল্লির রাস্তা প্রদক্ষিণ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য জনসমর্থন এবং অর্থ আদায় করতে।

৩ জুলাই কলকাতার সার্কাস এভিনিউস্থ পাকিস্তান দূতাবাসে পাকিস্তানি পতাকা সরিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানোর ক্ষণে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি (যেটি স্বাধীনতার পর আমাদের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পায়) গেয়েছিলেন স্বনামধন্য রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্র। একই সময়ে কলকাতা বেতারে অবিরত বাজত অংশুমান রায়ের কণ্ঠে ‘শোন একটি মজিবুরের কণ্ঠ’। কয়মাস পরে রবীন্দ্র সদনে পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য পয়সা তুলতে গান গেয়েছিলেন আরেক কিংবদন্তি রবীন্দ্র গায়ক দেবব্রত বিশ্বাস। আরও গেয়েছিলেন কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোক তরু বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রাতস্মরণীয় কণ্ঠশিল্পীরা। সেদিন ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার সময় অঝোরে সুচিত্রা মিত্র কাঁদছিলেন বলে লিখেছেন সম্পাদক আবুল হাসনাত। তা দেখে শ্রোতারাও অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। (আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা ২০২১ সালের ৪ জুলাই থেকে সংগৃহীত)।

অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের লেখা থেকে জানা যায়, ২৮ এপ্রিল ওপার বাংলা (পূর্ব বাংলা) থেকে আগত বুদ্ধিজীবীদের সাহায্যার্থে প্রখ্যাত উপন্যাসিক তারা শংকর বন্দ্যোপাধ্যায় আবেদন করেছিলেন পূর্ব বাংলা থেকে আসা শিল্পী, সাহিত্যিকদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘বাংলাদেশ সহায়ক শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী সমিতি’ যে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, সেখানেও শ্রোতা ধারণের জায়গা হয়নি। বিজ্ঞাপন মারফত জানা যায়, অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, আশোক তরু বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সাগর সেন, নীলিমা সেন। এ ছাড়াও ছিলেন অপর্ণা সেন এবং দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিরা। তাঁর লেখা থেকে আরও জানা যায় যে, বাংলাদেশের তরুণ নাট্যকার শাহরিয়ার কবির লিখিত ‘রূপান্তরের গান’ গীতিনাট্যটি কলকাতা ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মঞ্চস্থ হয় যাতে বংলাদেশের প্রখ্যাত অভিনয়শিল্পী এবং কণ্ঠশিল্পীরা অভিনয় করেছিলেন। কলকাতার অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন সুচিত্রা মিত্র এবং প্রারম্ভিক ভাষণ দিয়েছিলেন দীপেন্দ্র নাথ। অধ্যাপক মামুনের তথ্যের প্রধান উৎস ছিল সানজিদা খাতুনের গ্রন্থ ‘সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দে’ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন পত্রিকা।

একাত্তরের ৩ জুলাই বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শাহরিয়ার কবির রচিত ‘রূপান্তরের গান’ গীতিনাট্যটি দেখার জন্য ২০ হাজার দর্শক টিকিট কিনে তাতে উপস্থিত হয়েছিলেন। খরচ বাদে টিকিটের পয়সা যায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া উদ্বাস্তুদের সাহায্যার্থে। অনুষ্ঠানটি অধিক আকর্ষণীয় করার জন্য উপস্থিত ছিলেন বরেণ্য কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সুকণ্ঠের এবং সম্মোহনী শক্তির অধিকারী ভাষ্যকার, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় শাহরিয়ার কবিরের রূপান্তরের গানের কথা প্রচার করেছিলেন কলকাতা বেতারের মাধ্যমে। সেই অনুষ্ঠানের কারণে মাহমুদুর রহমান বেনু, শাহিন সামাদ, ডালিয়া নওশীন, বুলবুল মহলানবীশ, নায়লা খান, ওয়াহিদুল হক, রূপা খান প্রমুখ বাংলাদেশের কণ্ঠশিল্পী পশ্চিম বাংলায় পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তা লাভ করেন। সনজিদা খাতুন অবশ্য আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, দেবু চৌধুরী, শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অপর্ণা সেনের ধারা বিবরণীর মাধ্যমে তাঁরা পশ্চিম বাংলায় প্রশংসিত হয়েছিলেন। ‘রূপান্তরের গান’ গীতিনাট্যটি দিল্লিতেও মঞ্চস্থ হয়েছিল যেখানে ঋত্বিক ঘটক বিশেষ ভূমিকায় ছিলেন। ডালিয়া নওশীন লিখেছেন- “ওখানকার পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীসমাজ ছিল একটা- যেখানে এমন কোনো শিল্পী নেই যে বাদ ছিল। প্রত্যেকে মিলে ওনারা আমাদের স্পন্সর করতেন, পেট্রোনাইজ করতেন। আপনি যার নামই বলতে চান দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় হোক, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় হোক, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় হোক, নির্মলেন্দু চৌধুরী হোক, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কবি-মানে আমি তো গিয়ে গিয়ে শিখেছি এগুলো। তখন কাউকে চিনি না জানি না।

অপূর্ব একটা সময় ছিল। আমরা শুধু ওনাদের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম তা নয়, কো-অপারেশনও পেয়েছিলাম। যে জন্য ওনারা আমাদের নিয়ে এত কিছু করতে পেরেছেন এবং যে উদ্দেশ্যে করেছি সেটাতে আমরা সফল হয়েছি। ” তিনি আরও লিখেছেন- “আমার মনে আছে দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায়, যেটা ফিরে এসে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অপর্ণা সেন ওরা একদম যেন নিকটে চলে এসেছিলেন। ”

কলকাতা, বোম্বে, দিল্লি প্রভৃতি শহরে অনুষ্ঠানগুলোতে আরও গান গেয়েছিলেন ভূপেন হাজারিকা, আরতি মুখোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু চৌধুরী, রুমা গুহঠাকুরতা প্রমুখ শিল্পী।

সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের জনসাধারণ অসামান্য অবদান রেখেছেন। মকবুল ফিদা হুসেনের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর ছবি এঁকে বোম্বের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য। বিকাশ ভট্টাচার্য, প্রকাশ কর্মকার, সুনীল দাশ, শ্যামলদত্ত রায় ও গণেশ পাইনের মতো খ্যাতিমান শিল্পীরা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে মাসের পর মাস বাংলাদেশের ওপর ছবি এঁকে বিক্রি করেছেন এবং ছবি বিক্রির টাকা শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে দিয়েছেন। শিল্পী বাঁধন দাস ছবি আঁকা ছেড়ে শরণার্থী শিবিরে গিয়ে চিকিৎসাকেন্দ্র খুলেছিলেন তাঁর এক ডাক্তার বন্ধুকে নিয়ে। অন্নদা শংকর রায়, মৈত্রেয়ী দেবী, গৌরী আইয়ুব, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিময় রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মহারাণী বিভূকুমারী দেবী, কাইফি আজমী, ওয়াহিদা রেহমান, লতা মঙ্গেশকর, বিষ্ণুকান্ত শাস্ত্রী, আলী সরদার জাফরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, প্রণবরঞ্জন রায়, তরুণ সান্যাল, মনোজ বসু, নিখিল চক্রবর্তী, রমেণ মিত্র, ইলা মিত্র, গীতা মুখার্জি, স্বাধীন গুহ, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণবেশ সেন, সন্তোষ কুমার ঘোষ, গোবিন্দ হালদার, অংশুমান রায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকা, শ্যামল মিত্র, সুচিত্রা মিত্র, রুমা গুহঠাকুরতা, হিরন্ময় কার্লেকার, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায়, শঙ্খ ঘোষ, অমিতাভ চৌধুরী, সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত, মানস ঘোষ, বাসব সরকার, পঙ্কজ সাহা, রবীন সেনগুপ্ত, অঞ্জলী লাহিড়ী, অনীল ভট্টাচার্য, অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তী, মৃন্ময়ী বোস এবং আরও অনেক খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করতে গিয়ে নিজেরাই রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধায়। রণাঙ্গনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন দুই তরুণ সাংবাদিক, অমৃতবাজারের দীপক ব্যানার্জি এবং আনন্দবাজারের সুরজিৎ ঘোষাল। দিল্লির শিল্পী নীরেন সেনগুপ্ত, ধীরাজ চৌধুরী, জগদীশ দে আর বিমল দাসগুপ্তের মতো শিল্পীরা দিল্লি, বোম্বে আর কলকাতায় প্রদর্শনী করে ছবি বিক্রির টাকা তুলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ তহবিলে। শিল্পীরা বাংলাদেশের ওপর ছবি এঁকেছেন, গাইয়েরা বাংলাদেশের জন্য গান গেয়েছেন, নাট্যকর্মীরা নাটক করেছেন; ঋত্বিক ঘটক, হরিসাধন দাসগুপ্ত, শুকদেব আর গীতা মেহতারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। বাংলার বাইরে বোম্বের চলচ্চিত্রজগতের সব উজ্জ্বল তারকা বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য কনসার্ট করে অর্থের জোগান দিয়েছেন।

তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখক রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছেন। সব মিলিয়ে ভারতের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের ভিতর এমন ব্যক্তি খুব কমই পাওয়া যাবে যাঁরা কোনো না কোনোভাবে তখন বাংলাদেশকে সাহায্য করেননি।

জুলাই মাসে জহির রায়হান তাঁর তৈরি ‘জীবন থেকে নেয়া’ কলকাতায় বিক্রি করে সে টাকা প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, ছবিটি নিলামে ৬ লাখ টাকা বিক্রি করে হল মালিককে ২ লাখ টাকা দেওয়ার পর বাকিটা প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে প্রদান করেন। ছবিটি কলকাতার এক প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের সময় সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক উপস্থিত থেকে দর্শকদের উৎসাহিত করেন। ভারতের কয়েকজন কিংবদন্তি শিল্পী যথা- রবি শংকর, সুমন কল্যাণপুর যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় সংগীতানুষ্ঠান করে যে প্রচুর পরিমাণ অর্থ জোগাড় করতে পেরেছিলেন তার পুরোটাই দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের জন্য। উল্লেখ্য যে, পণ্ডিত রবি শংকরের উদ্যোগেই নিউ ইয়র্কে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সত্যজিৎ রায়ের ‘দুই কন্যা’ ছবিটি কানাডায় কয়েকবার প্রদর্শনের পর প্রাপ্য অর্থও অক্সফামকে দেওয়া হয় বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের জন্য। মুম্বাইতেও গড়ে উঠেছিল ‘বৃহৎ বোম্বাই বাঙ্গালি সমাজ’। ৩ মে তারা এক সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেন যাতে গান গেয়েছিলেন শচিন দেব বর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, নির্মলেন্দু চৌধুরী। উপস্থিত ছিলেন সলিল চৌধুরী, শর্মিলা ঠাকুর, দীলিপ কুমার, হেমা মালিনি, রাজেশ খান্না, সায়েরা বানু, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মতো দেশ কাঁপানো সংগীত এবং চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বরা। অনুষ্ঠানে ৩০ হাজার দর্শক ছিলেন। শচিন কর্তা ‘নিশিথে যাইও ফুলে’ ছাড়াও ‘বাজে বাংলাদেশের ঢোল’ গেয়ে অনুষ্ঠান মাতিয়েছিলেন। গানগুলো হিন্দিতে অনুবাদ করেছিলেন জাকির হোসেন নামে এক কবি। তারপর চারটি গান গেয়েছিলেন পশ্চিম বাংলার জনপ্রিয় পল্লীগীতি গায়ক নির্মলেন্দু চৌধুরী। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি মহারাষ্ট্রের মন্ত্রী ডা. রফিক জাকারিয়া বলেছিলেন, “আমাদের অসহায়ভাবে নিশ্চেষ্ট হয়ে পাকিস্তানি বর্বরতার দিকে তাকিয়ে বসে থাকা অতি লজ্জার কথা। ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। ”

৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায় অমৃত পত্রিকায় লিখেছিলেন- “পূর্ব বাংলায় যা হচ্ছে তা অতি শোচনীয় ব্যাপার সন্দেহ নেই। মুজিবুর রহমান এবং তাঁর অনুসারিরা বীর পুরুষ। মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা জানিয়েছি এক কবিতায়। কবিতার নাম ‘সহস্র সালাম’। জুন মাসে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ মৈত্রী পরিষদ’। ২২ জুন সেই সংস্থার অনুষ্ঠান হয় রবীন্দ্র সদনে যেখানে অংশ নিয়েছিলেন সুচিত্রা মিত্র, অশোক তরু বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, সাবিতা চৌধুরী ও মান্না দে। ‘বাংলা আমার বাংলা’ শীর্ষক একটি গানের রেকর্ড করে সেই রেকর্ডের রয়্যালিটি দান করেছিলেন উদ্বাস্তুদের সহায়তায়।

কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রীলংকায় গিয়েছিলেন সেখানে গান গেয়ে অর্থ উত্তোলন ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণার জন্য। এপ্রিল মাসেই মুম্বাইতে জন্ম হয় ‘বাংলাদেশ এইড কমিটি’, প্রেরণায় ছিলেন কাইফি আজমি, ওয়াহিদা রহমান, মীনা কুমারী, উর্দু কবি আলি সর্দার জাফরি, কাওয়ালি শিল্পী ইউসুফ আজাদ ও রাশিদা খাতুন।

বিখ্যাত অংকনশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন, বিমল দাসগুপ্ত, ধীরাজ চৌধুরী, নীরেন সেনগুপ্ত ২৫ মে বিরলা একাডেমিতে অংকিত চিত্রের প্রদর্শনী করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর তহবিলে বিক্রিত অর্থ প্রদানের জন্য।

সাহিত্যজগতের যারা বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্নদা শংকর রায়ের কথাও ভোলার নয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে কলকাতায় ‘পশ্চিম বাংলা-বাংলাদেশ সম্প্রীতির’ সভায় অন্নদা শংকর ছাড়াও ভাষণ দিয়েছিলেন মনোজ বসু, প্রবোধ কুমার সন্যাল প্রমুখ। গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্বামী শ্যামল গুপ্তও পিছিয়ে ছিলেন না। মহানায়িকা সুচিত্রা সেনও শুরু থেকেই ভূমিকায় ছিলেন। ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির কলকাতা সফরকালে তিনি সেই শহরে যে সভায় ভাষণ দেন সেখানে তাঁর পাশেই বসা ছিলেন সুচিত্রা সেন।

মুক্তিযুদ্ধকালে গীতাদত্ত ছিলেন শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তারপরও তিনি মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শারীরিকভাবে তখন তাঁর সেই ক্ষমতা ছিল না। রথীন্দ্রনাথ রায়, আবদুল জব্বার প্রমুখ বাংলাদেশি শিল্পীকেও ভারতীয়দের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন দেবদুলাল, অপর্ণা সেন প্রমুখরা।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

মুক্তিযুদ্ধ,শিল্পী-সাহিত্যিক,ভারত
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close