• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

২০৭১

প্রকাশ:  ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৩:৩২
সৈয়দ বোরহান কবীর

২০৭১ সালে কেমন হবে বাংলাদেশ? চলুন ঘুরে আসি টাইম মেশিনে-

১.

২০৭১ সাল। পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত, আধুনিক, শান্তিময় এবং পরিবেশবান্ধব দেশটির স্বাধীনতার শতবর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। দেশটির নাম বাংলাদেশ। শতবর্ষ আগে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই দেশটি স্বাধীন হয়েছিল। স্বাধীনতার পর এই দেশটি ছিলো ক্ষুধা দারিদ্রের প্রতীক। দুভিক্ষের দেশ। আজ এই দেশটি সারা বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল। সারা বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ দরিদ্র মানুষ বাংলাদেশ থেকে কোন না কোন সহায়তা পায়। ২৬ মার্চ দেশটির স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের মধ্যে দিয়ে শতবর্ষ পূর্তি শুরু হয়, ১৬ ডিসেম্বর দেশটির বিজয় দিবস দিয়ে বছর ব্যাপী অনুষ্ঠানের শেষ হচ্ছে। সমাপনী অনুষ্ঠানে ধনী গরীব সব দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা এসেছেন। অনুষ্ঠানে ধনী গরীবের ভেদাভেদ করা হয়নি। বরং যে সব দেশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছিল তাদের আলাদা সম্মান দেয়া হয়েছিল। অনুষ্ঠানে দারিদ্রে জর্জরিত ইউরোপের দেশগুলো থেকে সরকার প্রধানরা এসেছেন। গৃহযুদ্ধে বিভক্ত জর্জরিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এসেছেন। আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা পর্বের পর সবাই জাতির পিতার সমাধিতে পুষ্পাস্তক অর্পন করলেন। তারপর চা চক্র। চা চক্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কোনভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটু কথা বলার কসরত চালাচ্ছেন। অনেক কষ্টে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি চলে এলেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে দেখে একটু ম্লান হাসি দিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কাছে চলে এসে সুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন ‘আমরা আপনাদের দরিদ্র মানুষের ত্রানের জন্য যে এক হাজার কোটি টাকা দিয়েছিলাম, তাতে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে জেনেছি।’ মুহূর্তেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেল। বললেন ‘ম্যাডাম প্রাইম মিনিষ্টার, দুর্নীতির কোন অভিযোগ প্রমাণিত নয়।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘তাছাড়া আপনাদের দেশে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ঘটছে। গুম, হত্যা এগুলো কিন্তু বাংলাদেশ বরদাস্ত করে না।’ কাচুমাচু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মাথা নাড়লেন। বললেন ‘সামনে শীত, ত্রান সাহায্য না পেলে বহু মার্কিনী মারা যাবে।’ প্রধানমন্ত্রী একটু ভাবলেন, বললেন ঠিক আছে আপনি আমাদের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলুন। এর মধ্যেই তাকে প্রায় ধাক্কা দিয়েই বাংলাদেশের প্রদানমন্ত্রীর কাছে চলে আসেন গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী। বললেন বাংলাদেশের সাহায্যের জন্য গ্রীসের জনগণ কৃতজ্ঞ। সাহায্য একটু বাড়ালে ভালো হয়। এভাবে একে একে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষ হলো। অনুষ্ঠান শেষ হলো আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শেখ হাসিনাকে স্মরণ করার মধ্যে দিয়ে। তিনি বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার সূচনা করেছিলেন। যে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ। আর এটা সম্ভব করেছে প্রাণশক্তিতে ভরা এদেশের অমিত সাহসী মানুষ।

২.

রংপুরের কৃষক বিজয়ের শতবর্ষের অনুষ্ঠান শেষ হবার পর, স্কাইপে ক্ষেতের কৃষকদের সাথে কথা বললেন, ক্ষেতে একটু পানি ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিলেন। বলে রাখা ভালো, ২০৫২ সাল থেকে বাংলাদেশ ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে না। বিশ্বের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েরা ২০৪১ সাল থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উপায় নিয়ে কাজ করে। ২০৪৮ এ গোটা বাংলাদেশকে বৃষ্টির পানির আওতায় আনা হয়। বৃষ্টি হলে, বৃষ্টির পানি চলে যায় সংরক্ষণ ভান্ডারে। সারাদেশে এরকম ১০ কোটি রিজারভার গড়ে তোলা হয়েছে। এখন কেউ নদী, পুকুর এবং মাটির নীচের পানি ব্যবহার করে না। রিসাইক্লিং পদ্ধতিতে বৃষ্টির পানি দিয়ে কৃষি, খাবার পানিসহ সব পানির প্রয়োজন মেটানো হয়।

বাংলাদেশে জমি বিভাজন আল নেই। বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে শুধু ফসলের মাঠ। সারা বছর এখানে নানা রকমের শস্য উৎপাদিত হয়। প্রত্যেক কৃষি জমির মালিক ভার্চুয়াল ডাটা এবং স্যাটেলাইটের সাহায্যে তার জমির ফসলের খোঁজ খবর নেন। বিশ্বের অন্যতম সেরা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনবদ্য আবিস্কারে গত ২০ বছর ধরে বাংলাদেশের কৃষিতে জৈব সার ছাড়া আর কিছুই ব্যবহার হয় না। ইউরিয়া, ফসফেট সহ কৃত্রিম সার ব্যবহার না করে, মানুষ ও পশুর বর্জ্য দিয়ে পরিবেশ বান্ধব সারই কৃষির চেহারা পাল্টে দিয়েছে। কৃষক স্যাটেলাইটে জেনে নেন, আবহাওয়ার খবর। সে অনুযায়ী তিনি কৃষি শ্রমিকদের পরামর্শ দেন। কৃষি শ্রমিকরা অধিকাংশই বিদেশী। বেশীরভাগই মধ্যপ্রাচ্যের হত দরিদ্র রাষ্ট্র থেকে এসেছে। এদের উপর অনেক দয়া হয় কৃষক রহমতের। বাবার কাছে শুনেছেন প্র-পিতামহ মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশের কাজ করতো। তার সাথে অমানবিক আচরণ করা হতো। একসময় অত্যাচারে কষ্টে তার প্র-পিতামহ মারা যান। এজন্য রহমত কোন বিদেশী শ্রমিকের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন না। বরং তিনি সব সময় বিদেশী কৃষি শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা চিন্তা করেন। কারণ রহমত জানে বাংলাদেশকে পাল্টে দিয়েছে এদেশের মানুষ। তাই মানুষকে অবহেলা করতে নেই।

৩.

চট্টগ্রামের শিল্পপতি ওমর। বিশ্বের একশো একুশটি দেশে তার শিল্প কারখানা। প্রায় এককোটি লোক এসব শিল্পে কাজ করে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সবগুলো কারখানায় এর সঙ্গে তিনি ভার্চুয়াল কনফারেন্স করেন। বাংলাদেশের সৌর বিদ্যুৎ প্রযুক্তি এবং পরিবেশ বান্ধব কৌশল এখন সারা বিশ্বের আরাধ্য। ২০৫০ সাল থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে শুধু মাত্র সৌরশক্তি এবং পানি ব্যবহার করে। কয়লা ও গ্যাস ব্যবহার করে পরিবেশ বিনাস করার আত্মঘাতী প্রবণতা বন্ধ করে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ওমর কোন কারখানায় গ্যাস, তেল বা কয়লা ব্যবহার করে না। ওমর সবদেশে প্রযুক্তি হস্তান্তর করে ফ্যাক্টরী গুলো করেছেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তার পোশাক শিল্পগুলোতে বিশেষ নকশায় পোষাক তৈরী করা হয়েছে। লাল-সবুজের সমন্বয়ে এই পোষাক এখন বিশ্বে জনপ্রিয়তার শীর্ষে।

ওমরের প্রত্যেকটা কারখানা যেন একেকটা বিশাল ফাইভস্টার হোটেল। এখানে কোয়ালিটি কন্ট্রোলের কাজ করে চুয়েট এর আবিস্কার ‘ফ্যাক্টরী রোবট’। ওমর বিজয়ের শতবার্ষিকীতে ঘোষণা করেন, তার ফ্যাক্টরীর লাভের দশ শতাংশ ইউরোপ, আমেরিকার ও মধ্যপ্রাচ্যের দারিদ্র বিমোচনের জন্য দান করবেন। ওমর শুনেছেন, এক সময় বাংলাদেশের মানুষও অনেক গরীব ছিলো, না খেয়ে থাকতো। বাংলাদেশকে বলা হতো বটমলেস বাসকেট। ওমর হাসেন। জাতির পিতা এবং তার কন্যা আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শেখ হাসিনার ছবিতে স্যালুট করেন। আর নিজেই বিড় বিড় করে আবৃত্তি করেন ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই’। ওমরের মতো এরকম শতাধিক বাঙালী শিল্প উদ্যোক্তাদের হাতেই আজ শিল্পন্নোত বাংলাদেশ। বিশ্বের শিল্পখাতে বাংলাদেশের অবদান ২১ ভাগ।

বাংলাদেশে ২০১৬ থেকে যে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল, তা শুধু প্রযুক্তিনির্ভর ছিলো না। বরং মানবশক্তির সাথে প্রযুক্তির মেলবন্ধন ছিলো এই শিল্প বিপ্লবের মূল সূর। এজন্যই মেশিন আর হাতের বৈরীতা হয়নি হয়েছে সক্ষতা। বাংলাদেশের শিল্প বিপ্লব মানুষের জয়গান।

৪.

বাংলাদেশের সবগুলো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যেন অতুলনীয় স্থাপত্যের এক অনুপম প্রদর্শনী। একে তো বিজয়ের শত বার্ষিকী, অন্যদিকে এসময় বাংলাদেশের অপূর্ব আবহাওয়ার কারণে পর্যটক উপচে পরে। পর্যটক আসে ব্রাজিল, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক ও চীনের মতো উন্নত দেশগুলো থেকে । বাংলাদেশ বিমান বায়ুচালিত। এটাও বিশ্বে অন্যতম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের আবিস্কার। বাতাসকে শক্তি বানিয়ে বিমান চালানোর এই আবিস্কার বিশ্বে পরিবেশ রক্ষায় অনন্য অবদান রেখেছে। সিলেটের সুনামগঞ্জে যে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ব্রাজিলের পর্যটক আলবার্তো পেরেইরা নামলেন, তা মনে হবে লেক। শাপলা ফুটে আছে চারপাশে। ইমিগ্রেশন চেক করে তিনি উঠলেন এক সোলার পাওয়ার সসারে। আকাশ থেকে বাংলাদেশটা যেন একটা ছবি, সবুজ আর সবুজ। রাঙ্গামাটির পাঁচতারা হোটেলে নামলে তাকে দেয়া হলো অর্গানিক গ্রীন টি। তাকে বলা হলো বাংলাদেশে স্বাগতম। কিন্তু এই দেশে পরিবেশ বিনাশী কোন কাজ আইনত: নিষিদ্ধ। গাছের পাতাও ছেড়া যাবে না। পেরেইরা ভাবলেন, আহরে আমার দেশটা কবে এমন হবে।

বাংলাদেশে সব যানবাহন সৌরবিদ্যুৎ চালিত অথবা বাস্প চালিত। কোথাও কোন দূষণ নেই, ময়লা নেই। হোটেল রুমে বসে আলবাতো ‘বাংলাদেশের ইতিহাস বইটা নিয়ে মগ্ন হলেন। অবাক বিস্ময়ে জানলেন, একশো বছর আগে এই দেশটা ছিলো বিশ্বের সবচেয়ে গরীব দেশগুলোর একটি। অনাহারে মানুষ মারা যেতো, প্রাকৃতিক দূর্যোগে থাকতো অসহায়.......। রুম সার্ভিসের বেলে সম্বিত ফিরলো তার। ছেলেটা মার্কিন নাগরিক। এখানে তিন বছর ধরে কাজ করে। আলবার্তো তাকে জিজ্ঞেস করলো, এখানে কেমন লাগে। ছেলেটি উচ্ছাসিত ভাবে জানালো খুব ভালো। আলবার্তো তাকে জানালো এদেশের কোন জিনিসটা ভালো। উত্তরে বেল বয় ছেলেটা বললো ‘মানুষ’। এখানকার মানুষ অনেক ভালো, অতিথি পরায়ন, সহানুভূতি প্রবণ।

৫.

বিজয় দিবসের পর দিনই বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত সাতটি (জি-৭) দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশে। বিশ্বের সবচেয়ে নয়নাভিরাম শহর ফরিদপুরে। দেশগুলো হলো, বাংলাদেশ, ভারত, চীন, ব্রাজিল, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভিয়েতনাম। এরা সবাই বাংলাদেশের বিজয় শতবার্ষিকীর অনুষ্টানে যোগ দিতে বাংলাদেশ এসেছিলেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে গ্রুপ সেভেনের বৈঠকে প্রথমেই ইউরোপজুড়ে দুর্ভিক্ষ এবং গৃহযুদ্ধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদী সংহিংসতায় সহস্রাধিক মানুষ নিহত হবার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানায় গ্রুপ সেভেন। বৈঠকে অবিলম্বে গৃহযুদ্ধ বন্ধের আহবান জানানো হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী গৃহযুদ্ধ নিরসনে নিয়োজিত শান্তিরক্ষী বাহিনীতে আরো বাঙালী সৈন্য বাড়ানোর অনুরোধ করেন। উত্তরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর দুকোটি পঞ্চাশ লাখ সদস্য শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত। তিনি সমঝোতা এবং ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’ দর্শণের আলোকে আপোষ ফমূলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, বর্ণবাদী সরকার গুলোর উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে হবে। চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, বর্ণবাদী তৎপরতা বন্ধ না করলে মার্কিন ও ইউরোপে সাহায্য বন্ধ করতে হবে। সভায় মধ্যপ্রাচ্যের দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশ দশ লাখ কোটি টাকার নগদ সহায়তার ঘোষণা দেন। আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর চা চক্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী একটু খোঁচা দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার কি মনে হয় না আপনি মধ্যপ্রাচ্যে সাহায্যের ব্যাপারে একটু বেশী হাতখোলা।’ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্মিত হাসেন। বলেন ‘আপনার কি মনে হয় না, ইউরোপ আর আমেরিকার কারণেই মধ্যপ্রাচ্যের এই দূদর্শা। আর ইউরোপ আমেরিকার সংকট তো তাদের নিজেরই সৃষ্টি।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মাথা নাড়েন, ‘তা বটে। কিন্তু এক সময় মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের প্রচুর শ্রমিক কাজ করতো। সেজন্য’.... ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কথা শেষ করার আগেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘ ‘সেটাতো আপনার দেশেরই বেশী ছিলো। আমাদের লোকজন কাজ করতো। জীবনের সব আনন্দ স্বপ্ন উজাড় করে দিয়ে পরিশ্রম করেছে।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রীও আবেগপ্রবণ হয়ে পরেন। বলেন ‘বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ কি জানেন? উত্তরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘এদেশের মানুষ।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্মতি সূচক মাথা নাড়েন।

৬.

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটি। বিদ্যুৎ নেই দুই ঘণ্টা। ম্যানহাটনের ফিফথ এভিন্যুতে আশ্রয় শিবিরে বাংলাদেশের চিকিৎসক ডা: জালাল চিকিৎসা দিচ্ছেন বর্ণবাদী দাঙ্গায় গুরুতর আহত কয়েকজনকে। জো রবার্ট গুরুতর আহত। তার মাথা ফেটে গেছে। জরুরী অপারেশন করা দরকার। ডা: জালাল তার স্যাটেলাইট কানেকটিভিটিতে (এক ধরণের আধুনিক ফোন) যোগাযোগ করলেন বাংলাদেশের সঙ্গে। জানালেন দ্রুত বিদ্যুৎ দরকার। ডা: জালালকে জানানো হলো ৫ সেকেন্ডের মধ্যে বিদ্যুৎ পাবে। বিদ্যুৎ এলো। চারপাশে অসংখ্য আহত মানুষের আর্ত চিৎকার। বাংলাদেশের চিকিৎসক দল দ্রুত চিকিংসা শুরু করলো। আহতদের অধিকাংশই কালো মানুষ। সাদারা দল বেঁধে তাদের বাড়ী ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। মারা গেছে শতাধিক। সারা রাত ধরে ডা: জালাল এবং তার দল আহতদের সেবা করলেন। সকাল নাগাদ জো রবাটের জ্ঞান ফিরলো। ডা: জালাল তার পাশে দাঁড়ালেন। জো কৃতজ্ঞতার হাসি ছড়িয়ে বললো-‘থ্যাংক ইউ এ্যান্ড ইয়োর কান্ট্রি’। ডা: জালাল গর্বিতভাবে বললেন ‘ইউ আর ওয়েলকাম’। রবাট জানতে চাইলো, ‘বাংলাদেশ শুনেছি শান্তির দেশ, কোন হানাহানি নেই, সন্ত্রাস নেই।’ ডাক্তার তার পাশে বসলেন। ব্যান্ডেজ দেয়া মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ‘শোন, ৫০-৬০ বছর আগে বাংলাদেশেও এমন ঘটনা ঘটতো।’ কিন্তু সে সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস দমনে কঠোর হন। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিয়েছিলেন। আজ তার ফল আমরা পাচ্ছি।’ এক সময় নিউইয়র্ক শহর ঘুমুতো না। আজ এটা অন্ধকারেই থাকে।’ রবাট জানতে চাইলো কিভাবে বদলে গেল বাংলাদেশ। উত্তরে ডা: জালাল গৌরবের হাসি দিয়ে বলেন, মানুষের অফুরান শক্তি আর আত্ম বিশ্বাসে।

৭.

পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ততম, চিত্রকর্ষ শহর ঢাকা। ঢাকার গুলশান হলো বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয় বহুল এলাকা। ঢাকা নেভার স্লিপ। প্রকৃতি আর আধুনিকতার এক অনবদ্য মেলবন্দ্বন ঘটেছে এই শহরে। গত দশ বছরে এই শহরে একটিও অপরাধ হয়নি। এমনকি একটি চুরিও না। এই শহরের লেকে প্রমোদ ভ্রমনের চেয়ে বড় বিনোদন পৃথিবীতে কম আছে। নানা বর্ণের নৌকায় ভ্রমন করা যায়। উদভ্রান্ত এক তরুণ তেম্নি এক নৌকায় বসে আছে। তাকে বিমর্ষ লাগছে। নৌকায় অন্যরা যখন লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করছে, তখন সে আনমনা। হঠাৎ সে বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মতো থমকে গেলো। মূর্তির মতো দাড়িয়ে রইলো, নড়তে পারছে না। নৌকায় উপস্থিত সবাই বুঝলো তার উপর স্যাটেলাইট থেকে জ্যামার বসানো হয়েছে। সে কোন খারাপ কাজ করার চিন্তা করেছিল। নৌকা বনানী লেক স্টেশনে নামতেই তাকে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুজন সদস্য ধরলো। স্ক্যানার দিয়ে তার শরীরে পরশ বুলিয়ে দিতেই সে আবার স্বাভাবিক হলো। দুই পুলিশ কর্মকর্তা তাকে ধরে নিয়ে গেলো। নৌকায় উপস্থিত বিদেশীরা বুঝতেই পারলো না কি হয়েছে। নৌকায় বসা এক তরুণকে বিদেশী পর্যটক জিজ্ঞেস করলো, কি হলো ব্যাপারটা। তরুণটি বললো-বাংলাাদেশ পর্যবেক্ষণ করছে ১০০টি স্যাটেলাইট টাওয়ার। এই টাওয়ারে আছে ‘এমজেড আই’ যন্ত্র। এটা হলো মাইন্ড রিডার এবং বডি জ্যামার। এই দেশে যে কোন মানুষের মন যখন অপরাধ প্রবণ হয় তখন তা ‘এমজেডআই’ এর মাইন্ড রিডার মেশিনে ধরা পরে। এটা ধরা পরার সাথে সাথে বডি জ্যামার দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়া হয়। এরপর পুলিশ তাকে নিয়ে যায়, সংশোধন করে ছেড়ে দেয়।’ কথাগুলো বলার সময় তরুণের চোখ ঠিকরে গৌরবের দ্রুতি বেরুচ্ছিল।’ বিদেশী বিস্ফোরিত চোখে জিজ্ঞেস করলো ‘এম জেড আই’ মানে কি? ‘মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বাংলাদেশের একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী।’ তরুণের উত্তর। ‘তিনি কি এই যন্ত্র আবিস্কার করেছিলেন?’বিদেশী জানতে চায়? ‘না, তিনি তরুণদের উজ্জীবিত করতেন, অনুপ্রাণিত করতেন বিজ্ঞান শিক্ষায়, গণিত শিক্ষায়। বিদেশের দামী চাকরী ছেড়ে তিনি বাংলাদেশে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানে শিক্ষকতা শুরু করেন। তার অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল তরুণ বিজ্ঞানী কুড়ি বছর আগে এই যন্ত্র আবিস্কার করে। গত ১৫ বছর ধরে এর বাণিজ্যিক ব্যবহার চলছে। ঐ তরুণরা মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এর নাম দিয়েছে ‘এম জেড আই’। এখন তাই অপরাধ শূন্য বাংলাদেশ।’ বিদেশী নিজেও যেন এই দেশে এসেছে ভেবে গর্ব অনুভব করে।

৮.

অষ্ট্রেলিয়ার কয়েকটি শহরে ব্যাপক সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অষ্ট্রেলিয়া সফর অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড, খেলোয়াড়দের নিরাপত্তার স্বার্থে এই মুহূর্তে অষ্ট্রেলিয়া যাওয়ার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সরকারের মতামত চেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ক্যাবিনেট ল্যাবে সব মন্ত্রীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল কনফারেন্সে বসেছেন। বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনার শেষ, অষ্ট্রেলিয়া সফর এজেন্ডা এলো। প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ থামলেন। ১০ মিনিটের জন্য মিটিং স্থগিত করলেন। সবগুলো স্ক্রিন বন্ধ হয়ে গেলো। প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ থামলেন। প্রধানমন্ত্রী কনফারেন্স রুম থেকে বেরুলেন, হঠাৎ স্মৃতি আচ্ছন্ন হয়ে পরলেন। চলে গেলো ৫৫ বছর আগে। যখন তিনি মাত্র ৬ বছরের শিশু। ক্রিকেট পাগল বাবার আদুরে কন্যা। বাবা দিনরাত কি পরিশ্রম করতেন, তার একমাত্র মেয়েকে খুশী করার জন্য। মেয়েটি সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করতো বাবা কখন আসবে। যে দিন বাংলাদেশের ক্রিকেট থাকতো, সেদিন বাসায় যেন উৎসব। মেয়েকে কোলে নিয়ে বাবার ক্রিকেট উদযাপন। সব সময় বাবা মেয়েকে জিজ্ঞেস করতো ‘মা আজ কে জিতবে’। মেয়ে অবলীলায় বলতো ‘বাংলাদেশ’। বাংলাদেশ জিতলে বাবা কাঁদতো, আনন্দের কান্না। মেয়ের জন্য গিফট। আর হারলে বাবার চেহারার দিকে তাকানো যেতো না। এরকম একটা সময়ে অষ্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশে আসার কথা ছিলো। তারা এলো না। তারা জানালো বাংলাদেশে যাওয়া অষ্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের জন্য নিরাপদ নয়। বাংলাদেশের জন্য ছিলো সেদিনটা চরম অপমানের, দু:খের। বাবার খুব মন খারাপ ছিলো সেদিন। শুধু বাবার কেন প্রতিটি বাঙালীই সেদিন কষ্ট পেয়েছিল। আজ সেই অষ্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশ যাবে কিনা, সে নিয়ে সিদ্ধান্ত দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী আকাশের দিকে তাকালেন। মনে হলো তার বাবার সাথে কথা বলছেন, কিংবা বাবার মতো অসংখ্য ক্রিকেট পাগল বাঙালীর সঙ্গে, যারা সেদিন আহত হয়েছিল, অপমানিত হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী চোখ মুছলেন, স্যাটেলাইটে সিগন্যাল পাঠালেন কনফারেন্স ওপেন করার জন্য। সবাই যেখানে আছে সেখান থেকে কনফারেন্স এ অংশ নিচ্ছেন। আলোচনায় অধিকাংশ মন্ত্রী অষ্ট্রেলিয়ার না যাবার পক্ষে। প্রধানমন্ত্রী স্বরণ করালেন ২০১৫ সালের কথা। যখন অষ্ট্রেলিয়া এলো না তখন আমাদের পূর্বসূরীদের কেমন লেগেছিল।কি কষ্ট পেয়েছিল এদেশের ক্রিকেট পাগল মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর আবেগতাড়িত ভাষণের পর সবাই রাজী হলো। বলা হলো, বায়োনিক স্পেসসীপের কাভারেজ দেয়া হবে বাংলাদেশের সব খেলায়। এই স্পেস শীপ দশমিক শূণ্য এক সেকেন্ডের মধ্যে অপরাধ সংঘটিত এলাকায় অপরাধ বন্ধের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেন ‘যারা আমাদের একসময় অবজ্ঞা করেছে অবহেলা করেছে আমরা তাদের সম্মান দেখাবো।’ এটাই মানুষের ধর্ম।

৯.

মিটিং শেষ করে প্রধানমন্ত্রী তার রুমে গেলেন। কটা দিন খুব ব্যস্ততায় কেটেছে। শতবর্ষ উদযাপন, বিদেশী অতিথিদের সময় দেয়া ইত্যাদি। আজ অনেকদিন পর এক টুকরো অবসর। এই অবসরে আবার প্রধানমন্ত্রী ছোট বেলায় চলে গেলেন। রোজ সকালে স্কুলে যাবার জন্য বেরুতেন বাবার সঙ্গে। বলা যায় বাবার গলা জড়িয়ে স্কুলে যেতেন। রাস্তায় থাকতো তীব্র যানযট। অস্থির হয়ে ছোট্ট মেয়েটি বাবাকে বলতো ‘বাবা বাংলাদেশ কবে উন্নত হবে।’ বাবা বলতো ‘২০৪১ সালে বা তার আগেও।’ বাবা কখনও আশা হারাননি সব সময় মেয়েকে বলবেন ‘বাংলাদেশ সবার সেরা। একদিন এদেশ সবচেয়ে উন্নত হবে।’ মেয়েটি অবাক বিস্ময়ে বাবার কথা শুনতো। প্রধানমন্ত্রী একাই হাসেন। চোখে জল আসে। তার বাবার মতো অসংখ্য বাবা, অসংখ্য মা যাদের পরিশ্রম, দেশের প্রতি ভালোবাসা আর গভীর আত্মবিশ্বাস বাংলাদেশকে আজ বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী দেশে পরিণত করেছে। বাংলাদেশের সাফল্য গাঁথা হলো আসলে অসংখ্য সাধারণ মানুষের অসাধারণ গল্পের যোগফল। বাবা কখনো প্রমিজ ব্রেক করেননি। বাংলাদেশ সেরা হবে এই প্রমিজটাও সত্যি হয়েছে। বাংলাদেশ আজ পরিপূর্ণ। বাংলাদেশের আরেক নাম পূর্ণতা। কোথায় বাবা? মনে পড়ে তার মায়ের কথা। মা বলেছিল, আমরা মরে গেলে প্রজাপতি হয়ে তোমার আশে পাশে থাকবো। যখন দেখবে দুটো প্রজাপতি পাশাপাশি তখন বুঝবে এটাই আমরা। প্রধানমন্ত্রী বারান্দায় যান। অনেক পাখী আছে। ফুল ফুটে আছে বাগানে। এর মধ্যেই দুটো প্রজাপতি পাশাপাশি একটা ফুলের উপর বসে আছে। প্রধানমন্ত্রী হেসে ফেলেন, নিজের অজান্তেই বলে উঠেন ‘জয় বাংলা’।

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

সৈয়দ বোরহান কবীর
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close