• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

দেশতো বাঁচলো, দল কি বাঁচবে

প্রকাশ:  ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:৪৬
সৈয়দ বোরহান কবীর

সিদ্ধান্তটি ছিলো অবধারিত। উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে দলীয় প্রতীক নৌকায় নির্বাচন করবে না, তা আগে থেকেই অনুমান করা যাচ্ছিল। বিশেষ করে, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর সারাদেশে আওয়ামী লীগের দলীয় এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কোন্দল, সহিংসতা প্রকাশ্য রূপ নেয়। সারাদেশে আওয়ামী লীগ দুই, তিনভাগে বিভক্ত। আওয়ামী লীগ সভাপতি টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেই, দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। কোন্দল, হানাহানি বন্ধ করে এক সাথে কাজ করার আহ্বান জানান। কিন্তু কে শোনে কার কথা। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়েছে। কেউ কউকে মানছে না। আওয়ামী লীগে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কৌশলের প্রেক্ষাপটে।

সম্পর্কিত খবর

    সদ্য সমাপ্ত এই নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে। বিএনপি ছাড়া একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন কিভাবে সম্ভব তা নিয়ে আলোচনা ছিলো। আবার ২০১৪ সালের মতো বিনা ভোটে এমপি হবার ধুম পড়বে কিনা তা নিয়েও সংশয় ছিলো। সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ছিলো, একতরফা নির্বাচন হলে ভোটার উপস্থিতি হবে একেবারেই কম। এরকম নির্বাচন আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি পাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা দেশ গুলো এই নির্বাচন মেনে নেবে না। নির্বাচনের পর আসবে নানা নিষেধাজ্ঞা, অবরোধ। নতুন সংকট সৃষ্টি হবে। যা হবে ভয়াবহ। আওয়ামী লীগ বিষয়টি ভালো করেই জানতো। দেশ বাঁচাতে, সংবিধান রক্ষায়, গণতন্ত্রের জন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিকল্প ছিলো না। কিন্তু সেই নির্বাচন যেন গ্রহণযোগ্য হয় তা নিশ্চিত করাটাও ছিলো বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন না হলে দেশে আবার এক-এগারোর মতো একটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা দখল করতো। জনগণ হতো অধিকারহীন। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়া নয় বরং দেশ বাঁচাতে সুষ্ঠু নির্বাচনই ছিলো শেখ হাসিনার জন্য অগ্নি পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে তিনি এক ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ঝুঁকি নেন।

    শেখ হাসিনা একজন চিন্তাশীল রাষ্ট্রনায়ক, একজন দার্শনিক। ২০১৮ সালের পর বিএনপি ছাড়া অনুষ্ঠিত নির্বাচন গুলো তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন, নিরীক্ষা করেছেন। নির্মোহ ভাবে এসব নির্বাচন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যেখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা দাঁড়িয়েছেন সেখানে নির্বাচন হয়েছে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। ভোট উৎসব হয়েছে, হয়েছে নির্বাচন কেন্দ্রিক উত্তেজনা। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা তো বটেই সিটি নির্বাচনেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের উত্তাপ চোখে পরেছে। গাজীপুর সিটি নির্বাচন ছিলো উৎসব মূখর নির্বাচনের টেষ্ট কেস। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লাহর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলো সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা। আজমত উল্লাহর মতো হেভিওয়েট প্রার্থীকে হারিয়ে দেন একেবারে আড়ালে থাকা এক গৃহবধু। মূলত: গাজীপুর নির্বাচনেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ফর্মুলা পায় আওয়ামী লীগ। বিএনপি ছাড়াও নির্বাচন যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং উৎসবমুখর হতে পারে গাজীপুর তার উদাহরণ। এরকম বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিংস পার্টির ওপর নির্ভর করেনি। আওয়ামী লীগ জনগণের দল। মাঠের খবর তারা ভালোই জানে। তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম যে ভোটের মাঠে গুরুত্বহীন তা শেখ হাসিনা ভালো করেই জানতেন। এজন্য শুরু থেকেই তিনি এসব দলের ওপর খুব একটা আস্থা রাখেননি।

    জাতীয় পার্টির অবস্থাও যে করুন, সেটা আওয়ামী লীগ সভাপতি জানতেন। এজন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের জন্য এসব দলের ওপর নির্ভর করেননি। ‘গাজীপুর মডেল’ অনুসরণ করে তিনি জাতীয় নির্বাচন দলের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হবার সবুজ সংকেত দেয়া হয়। নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থী হন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেয়ার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যেন মাঠে থাকে, তাদের যেন বাধা না দেয়া হয়, সে বার্তাও দেয়া হয় প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর প্রচ্ছন্ন সমর্থন এবং সহানুভূতিও লক্ষ্য করা যায়। এমনকি স্পর্শকাতর কিছু আসনে স্বতন্ত্রদের বসিয়ে দেয়ার চাপও তিনি অগ্রাহ্য করেন। এজন্য ১৪ দলের সঙ্গেও আওয়ামী লীগের টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়।

    কুষ্টিয়া-২ আসনে নৌকা প্রতীক দেয়া হয়েছিল জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুকে। কিন্তু স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতা। একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল রাজশাহী এবং পিরোজপুরে। এই দুই জায়গায় ১৪ দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। ১৪ দলের পক্ষ থেকে এই সব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বসিয়ে দেয়ার আবদার ছিলো। কিন্তু শেখ হাসিনা সেই আবদার পাত্তা দেননি। এমনকি, আওয়ামী লীগের অনেক হেভিওয়েট প্রার্থীদের বিরুদ্ধেও স্বতন্ত্রপ্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন। কাউকেই চাপ দেয়া হয়নি, বরং সবাইকে স্বাগত জানানো হয়েছে।

    ৭ জানুয়ারির নির্বাচন যেটুক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং উৎসব মুখর হয়েছে, সেটা সম্ভব হয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্যই। অর্ধেক আসনে ভোট নিয়ে জনগণের আগ্রহ ছিলো। এরমধ্যে ৭০টি আসনে নির্বাচন হয়েছে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। যে কারণে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা সফল হয়নি। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও বিরোধীদলের অংশগ্রহণ ছাড়া এই নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বলা হলেও একবারে প্রত্যাখান করেনি। বরং এই নির্বাচনকে মন্দের ভালো হিসেবেই সকলে মেনে নিয়েছে। স্বতন্ত্রদের অংশগ্রহণের কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বলেও প্রত্যাখান করেনি। নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ‘স্বতন্ত্র ফর্মুলা’ আওয়ামী লীগের জন্য শুধু নয়, দেশের জন্যও এক বিরাট স্বস্তি। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়েছে জন্যই শেষ পর্যন্ত দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে। নির্বাচন উন্মুক্ত না করলে, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সুযোগ না করে দিলে শেষ পর্যন্ত এই নির্বাচন তামাশায় পরিণত হত। হয়তো এতদিনে নানা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার খড়গ নেমে আসতো।

    কিন্তু দেশ বাঁচাতে স্বতন্ত্রদের জামাই আদর করলেও এই নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল দলের ভেতর। ধীরে ধীরে এই কোন্দল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। চেইন অব কমান্ড সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙ্গে পড়ে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিভক্তি আরও বাড়ে। প্রতিটি জেলায় এমপি লীগ, আওয়ামী লীগ এবং মাই ম্যানদের নিয়ে বিভক্ত আওয়ামী লীগ মনোনয়ন নিয়ে এমনতিইে প্রকাশ্য কোন্দলে ছিলো। এই কোন্দল বিস্ফোরণে রূপ নেয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র নির্বাচনে বিদ্রোহীদের প্রার্থী হবার সুযোগ দেয়ার মধ্যে দিয়ে। দলের ভেতর যাদের ক্ষোভ, দু:খ ছিলো। এমপিদের বিরুদ্ধে যাদের অনেক আক্রোশ ছিলো, তারা প্রতিশোধ নেয়ার এক মোক্ষম সুযোগ পায়। বিভক্তির তাণ্ডবে ক্ষত বিক্ষত হয় সারাদেশে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগ লড়াই শুরু হয়। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম ‘কুইনাইন খেলে জ্বর সারবে বটে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে।’ আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীদের সুযোগ করে দিয়ে নির্বাচন হলো বটে, কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের ক্ষত সারবে কে। অনেকে মনে করেছিল, নির্বাচনের পর এই কোন্দল থেমে যাবে। কিন্তু নির্বাচনের পর কোন্দল থামেনি, বরং নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের সহিংসতা শুরু হয়েছিল, তা এখনও চলছে। সহিংসতা এবং কোন্দল বন্ধের জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি আহ্বান জানালেও সহিংসতা, কোন্দল বন্ধ হয়নি। এই বাস্তবতায় উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক বরাদ্ধ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ আগামী এপ্রিলে অনুষ্ঠিতব্য উপজেলা নির্বাচনে ‘নৌকা’ প্রতীক থাকবে না। দলীয় ভাবে কাউকে মনোনয়নও দেয়া হবে না। অনেকেই এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন।

    তারা বলেছেন, এর ফলে আওয়ামী লীগের কোন্দলের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে। দলীয় প্রতীক ছাড়া উপজেলা নির্বাচন করার যে সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ নিয়েছে তার দুটি দিক রয়েছে। এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল। এর ফলে দেশে রাজনৈতিক আবহে একটি গুনগত পরিবর্তন হবে। ৭ জানুয়ারিতে যারা ভোট বর্জন করেছিল, তাদের অনেকেই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবেন। বিশেষ করে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাদের এই নির্বাচন থেকে দুরে রাখা হবে প্রায় অসম্ভব। দেশে একটি নির্বাচনী আবহ তৈরি হবে। উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির একটি রাজনৈতিক সমঝোতার সূত্রপাত হবে বলেও আমার বিশ্বাস। জনগণের নির্বাচন কেন্দ্রিক অনীহা দূর করার ক্ষেত্রেও এই কৌশল কাজে দেবে। কিন্তু এই কৌশল আওয়ামী লীগের ভেতর কোন্দলের ক্ষত সারতে পারবে কিনা তা নিয়ে আমি সন্দিহান। দীর্ঘদিন জেলা, উপজেলায় আওয়ামী লীগের যে বিভক্তি। দুই তিন উপদলে বিভক্ত স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের মারামারি খুনোখুনি এই সিদ্ধান্তে বন্ধ হবে না। বরং কোন্দল আরও বাড়বে। যে যার মতো স্বতন্ত্র দাঁড়াবে। পেশী শক্তির পরীক্ষা হবে প্রকাশ্যে।

    আওয়ামী লীগের জন্য এখন সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হলো দলের অভ্যন্তরে কোন্দল বন্ধ। দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। নৌকা না দিলেই সবাই মিলে মিশে কোলাকুলি করবে, এমন ভাবার কোন কারণ নেই। আওয়ামী লীগে বিভক্তি হলো সুবিধাবাদী এবং চাটুকারদের সাথে। ত্যাগী এবং পরীক্ষিতদের। অনুপ্রবেশকারীদের সাথে দু:সময়ের কর্মীদের। হঠাৎ বনে যাওয়া নেতাদের সাথে নীরব কিছু না পাওয়াদের। লুটেরাদের সাথে সৎ নেতা কর্মীদের। তাই এই বিভক্তি দূর করার জন্য প্রয়োজন আদর্শের চর্চা, সাংগঠনিক পদক্ষেপ। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কার্যকর উগ্যোগ। আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে হবে। নির্বাচনে জয়ী হতে জাতির পিতার হাতে গড়া সংগঠনটি এখন ঝুঁকিতে। এই ঝুঁকি থেকে আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে দরকার দীর্ঘ মেয়াদী রাজনৈতিক কৌশল।

    সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

    ই-মেইল: [email protected]

    • সর্বশেষ
    • সর্বাধিক পঠিত
    close