• রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা স্থাপনে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

প্রকাশ:  ২০ মার্চ ২০২৪, ১৭:০৩
সায়মা আক্তার এশা

পোশাকশিল্পকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য রয়েছে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বে অন্যতম শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় ইউরোপিয়ান দেশ, বিশেষ করে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, স্পেনসহ আরও বেশ কয়েকটি দেশে। সেই সাথে আমেরিকা মহাদেশের দেশগুলোতেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রয়েছে অন্যতম অবস্থান।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই শিল্প গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও পরিবেশের জন্য এটি উদ্বেগ তৈরি করেছে। পোশাক কারখানাগুলোর কাপড় কাটা, সেলাই, প্রক্রিয়াজাতকরণ বায়ু, পানি এবং মাটি দূষণের জন্য দায়ী।

জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন ইউএনএফসিসি’র মতে, তৈরি পোশাক খাত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দূষণকারী খাত। পোশাকখাত বিশ্বের ২০% বর্জ্য পানি এবং ১০% কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের জন্য দায়ী। পোশাক শিল্প বাংলাদেশের নদী দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। উন্নত দেশগুলো তাদের পরিবেশ অবান্ধব খাত (যেমন পোশাক ও চামড়া শিল্প অন্যতম) তৃতীয় বিশ্বের দেশে পাঠিয়ে তাদের নদী ও পানি রক্ষার উদ্যোগ নেয়।

এরই ধারাবাহিকতায় অন্য কিছু ঘনবসতিপূর্ণ দেশের মতো বাংলাদেশ বিশ্বের বর্জ্যের আস্তানা হয়ে ওঠে। পোশাকশিল্পে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্য সরাসরি অশোধিত অবস্থায় বাংলাদেশের নদ-নদীতে উন্মুক্ত করে দেশের জল-স্থল প্রাণ প্রকৃতি বিষিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সেন্টার ফর এনভাইরনমেন্টের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের নদীগুলোতে প্রাণঘাতী ভারি ধাতুসহ প্রায় ৬০ ধরনের বিষাক্ত পদার্থ পাওয়া যাচ্ছে। একইসঙ্গে এটি সারা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পানি ব্যবহারকারী খাত।

প্রতি বছর কারখানাগুলোতে পোশাক ও তুলা ধৌতকরণ এবং রঙের কাজে ১৫০০ বিলিয়ন লিটার পানি ব্যবহৃত হয়। ব্যবহারের পর এই বিষাক্ত পানি নদী এবং খালে নিষ্কাশন করে কারখানাগুলো। বেশিরভাগ কারখানা নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় তাদের বর্জ্য নদীতে ফেলা হয়। ফলে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ। পানি দূষণের ফলে কমছে মাছের সংখ্যা ও চাষের উপযোগী জমি। বেশিরভাগ স্থানীয় কৃষক ও মৎস্যজীবীদের জীবিকা এখন ঝুঁকিপূর্ণ।

ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের গবেষণা অনুযায়ী, পোশাকশিল্পের কারণে বাংলাদেশ তার ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ হারাচ্ছে। ঢাকার পোশাক কারখানার জন্য সরবরাহকৃত পানির প্রায় ৮২% ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল। পানির এই বিশাল চাহিদা পূরণের জন্য, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ২-৩ মিটার পরিমাণে হ্রাস পাচ্ছে। যদি পর্যাপ্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয় তবে ২০৫০ সালের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ কমে গিয়ে ১১০ থেকে ১১৫ মিটারে নেমে যাবে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্ট এসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, পোশাক প্রক্রিয়াকরণে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ মাটির সঙ্গে মিশে ভূপৃষ্ঠ এবং ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত করে।

এছাড়া পোশাকশিল্পের বর্জ্য থেকে নির্গত মিথেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী। এই খাতে মাত্র ১৫% বর্জ্য পুনরায় ব্যবহার করা যায়। ফলে ৮৫% বর্জ্যই প্রকৃতিতে ফেরত আসে বলেও উল্লেখ্য করা হয় প্রতিবেদনটিতে।

ভবিষ্যতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতে বর্তমানে বিদ্যমান পোশাক শিল্প আরও সম্প্রসারিত হবে। তাই পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনতে টেকসই পোশাক কারখানার দিকে ধাবমান হওয়া জরুরি।

বর্জ্য নিষ্কাশনের পরিমাণ কমিয়ে আনতে কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। উদ্ভাবনী উদ্যোগ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিল্প কলকারখানায় পানির ব্যবহার হ্রাস করে বর্জ্য নিষ্কাশন কমানো প্রয়োজন। কাঁচামাল দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করলে বর্জ্যের পরিমাণ আরও কমিয়ে আনা সম্ভব। নদী ও জলাশয়কে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। পরিবেশবান্ধব মেশিন ব্যবহারসহ বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে হবে।

ভূ-গর্ভস্থ পানির অপচয় রোধে পোশাক কারখানাগুলোকে বৃষ্টির পানি ব্যবহারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এছাড়া উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে জ্বালানি, পানি ও বাষ্পের ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এতে অপচয় বন্ধ করে দক্ষতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। জীবাশ্ম উৎসের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করার প্রতি গার্মেন্টস মালিকদের সচেতন করতে হবে। পোশাক কারখানাগুলোতে যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয় তার ৮০% সৌর, বায়ু বা জলবিদ্যুতের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

কারখানা মালিক ও কর্মচারীদের মধ্যে এখনও পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। দেশের কারখানাগুলোর পরিবেশ-বিষয়ক তদারকির জন্য যথেষ্ট লোকবল নিয়োগ দিতে হবে।

ইউরোপ-আমেরিকান ক্রেতারা তুলনামূলক কম দামে যে “মেইড ইন বাংলাদেশ” পোশাক কিনছেন, তার প্রতিটি ইউনিট আমাদের মাটি, পানি ও বায়ু বিষিয়ে দিতে ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেটি প্রয়োজন, সেটি হলো অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোর সমাধান করা। পোশাক কারখানার অশোধিত ডাইয়িং বর্জ্য নদীতে উন্মুক্ত করা যাবে না। প্রতিটি কারখানায় কেন্দ্রীয় শোধনাগার তৈরি করা লাগবে। উচ্চমান শোধিত বর্জ্যই শুধু নদীতে উন্মুক্ত করতে হবে। এর ফলে বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে “প্রাইস নেগোসিয়েশন পাওয়ার” বাড়াবে। পোশাকের দামের সাথে এনভায়রনমেন্ট কস্ট জুড়ে দিয়ে বার্গেইনিং বাড়াতে হবে।

তবে এত চ্যালেঞ্জের মধ্যে কিছু সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। গত কয়েক বছরে দেশে বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তারা। ভালো উদ্যোগগুলো প্রচারের মাধ্যমে অংশীদারদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে এই সমস্যার সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

পোশাকশিল্প
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close