• বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ইঁদুর নিধন তার নেশা, পেয়েছেন অর্ধশত পুরস্কার

প্রকাশ:  ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ২২:৫৬
পূর্বপশ্চিম ডেস্ক
হোসেন আহম্মদ

প্রায় ৬ দশক ধরে নিজস্ব কৌশলে ইঁদুর নিধন করে জেলায় রীতিমতো সাড়া ফেলেছেন ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের দশপাইয়া এলাকার কৃষক হোসেন আহম্মদ। ৮৩ বছর বয়সী এই বৃদ্ধ পরিবেশবান্ধব উপায়ে ইঁদুর নিধন করে ইতোমধ্যে পেয়েছেন অর্ধশত পুরস্কার। ইঁদুর নিধনে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে পুরো জেলাজুড়ে৷

উপজেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, প্রতিবছর ফসল রক্ষায় অক্টোবর মাস থেকে নভেম্বর মাসরে প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালিত হয়। স্থানীয় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে উপজেলা, জেলা বিভাগীয় পর্যায়ে পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করে কৃষি বিভাগ। গত এক বছরে কৃষক হোসেন আহম্মদ ১০ হাজারেরও বেশি ইঁদুর নিধন করে উপজেলা, জেলা পর্যায়ে প্রথম ও বিভাগীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় হয়ে পেয়ছেন কৃষি বিভাগের পুরস্কার ও সম্মাননা।

হোসেন আহম্মদের ইঁদুর নিধন রয়েছে নিজস্ব কলাকৌশল। বাঁশের কঞ্চি ও তার দিয়ে বানানো ফাঁদে টোপ পেতে ইঁদুর নিধন করেন তিনি। টোপ হিসেবে ব্যবহার করেন ধান, গম, ডাল, শামুক ও নারকেল। ফাঁদে পা বাড়ালেই আটকে যায় ইঁদুর । কখনো কখনো খাঁচা বসিয়েও ইঁদুর ধরেন তিনি। পরে সেগুলো মেরে হিসেব রাখতে কেটে রাখেন ইঁদুরের লেজ৷ এভাবেই ৬০ বছর ধরে ইঁদুর নিধন কর আসছেন তিনি। এখন এটিই তার নেশা।

হোসেন আহম্মদ বলেন, ‘আমার বয়স যখন ৭/৮ বছর তখন থেকেই ইঁদুর নিধন শুরু করি। শুরুর দিকে ইঁদুর নিধন করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে লেজ জমা দিলে পুরস্কার পেতাম। সেসময় লেজ জমা দিয়ে দুইবার ১২০ গ্রাম করে গম পেয়েছিলাম। ৬০ বছর ধরেই এই কাজ করে আসছি। কাজের জন্য জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে অনেক পুরস্কারও পেয়েছি।’

হোসেন আহম্মদের ইঁদুর নিধনের গল্প এখন জেলা জুড়ে আলোচিত । ইঁদুরের উপদ্রব থেকে কৃষকের ফসল বাঁচাতে তিনি সর্বত্র ছুটে যান শর্তহীনভাবে। এজন্য কোনো বিনিময় কিংবা টাকা দাবিও করেন না তিনি। ইঁদুরের উৎপাত থেকে কৃষকের ফসল বাঁচলে এতেই খুশি হন তিনি।

তবে দীর্ঘ এ পথচলা খুব সহজ ছিলনা কৃষক হোসেন আহম্মদের জন্য। ইঁদুর মারেন বলে বহু কটুকথাও শুনতে হয়েছে তাকে। বিষয়টকে স্বাভাবিকভাবে না নেওয়ার কারণে মানুষজনের কাছে ইঁদুরের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরতে হতো তাকে।

হোসেন আহম্মদ বলেন, ‘কারো প্রয়োজন হলে আমার জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে ফাঁদ পেতে ইঁদুর ধরি। বিনিময়ে কোনো টাকা নেই না। অনেকে খুশি হয়ে মাঝেমাঝে চা-নাস্তা খাওয়ার জন্য কিছু টাকা দেন। যেখান থেকে ডাক আসে সেখানে গিয়ে ইঁদুর ধরি। যেখানে যাই সেখানকার মানুষদের ইঁদুর নিধন পদ্ধতিও শিখিয়ে দিয়ে আসি।’

কৃষি ও কৃষকের মঙ্গলে সারাজীবন কাজ করে যাওয়া হোসেন আহম্মদ এখনো কিছুই পাননি। আবেগাপ্লুত হোসেন বলেন, ‘সারাজীবন ধরে দেশ ও দেশের কৃষির জন্য কাজ করছি। যখনই ডাক পড়েছে মানুষের উপকার করেছি। কখনও বিনিময় চাইনি। বয়সের ভারে এখন কোনো কাজও করতে পারি না। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে খুবই কষ্টে দিন অতিবাহিত করছি। যদি সরকারি কোনো সহযোগিতা করতো তাহলে কোনো রকমে চলতে পারতাম।’

আকবর হোসেন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, বহুদিন ধরে উনাকে (হোসেন আহম্মদ) চিনি। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে তিনি ইঁদুর নিধনে কাজ করেন। এতে কৃষকের উপকার হচ্ছে। এ কাজের জন্য এখন পুরো সোনাগাজী উপজেলায় তাকে লেজওয়ালা দাদা নামেই চেনে।

মো. কামাল মিয়া নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষই কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। হোসেন আহম্মদ ইঁদুর নিধনের মাধ্যমে গ্রামবাসীর এবং ফসলের অনেক উপকার করছেন।

কৃষক হোসেন আহম্মদ নিজে ইঁদুর নিধনের পাশাপাশি গ্রামের অন্যান্যদেরও এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ইঁদুর নিধনে নিজের কৌশল শেখানোর পাশাপাশি সরঞ্জামাদি দিয়ে মানুষকে সহযোগিতা করেন।

মোজাফফর নামে স্থানীয় এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, তিনি নিজে কাজ করার পাশাপাশি আমাদের এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এ কাজের জন্য কখনো টাকা নেননি। বরং অনেক সময় আমাদের ইঁদুর ধরার বিভিন্ন সরঞ্জাম দেন।

মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নে দায়িত্বরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আজিজ উল্যাহ বলেন, ইঁদুর নিধনের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে এলাকাবাসী ও পরিবারের সদস্যদের উপহাসের পাত্র হয়েছেন হোসেন আহম্মদ। আমরা কাজের মূল্যায়ন করতে জানি না। যে লোকটি ইঁদুর মারার মাধ্যমে সবার উপকার করে যাচ্ছেন, অনেকেই তাকে নানা ব্যঙ্গাত্মক নাম দিয়ে ডাকেন।

সোনাগাজী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. আল আমিন বলেন, ইঁদুর প্রতিবছরই দেশে ৫০ থেকে ৫৪ লাখ মানুষের খাবার নষ্ট করে। সারাদেশের মতো সোনাগাজীতেও আমরা সারাবছর ইঁদুর নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমরা প্রায় ৮৩ হাজার ইঁদুর নিধন করতে সক্ষম হয়েছি। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ইঁদুর নিধনে ব্লক ভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপ কাজ করে।

ইঁদুর নিধনে জড়িতদের সাথে সামাজিক আচরণ ও কৃষি বিভাগের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে তিনি আরো বলেন, আমাদের আশপাশেই ইঁদুর বসবাস করছে। কিন্তু অনেকেই এটির ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানি না। একজোড়া ইঁদুর বছরে ১৫০০ থেকে ২০০০ হাজার প্রজনন ক্ষমতা রাখে। মূলত এই জ্ঞান না থাকার কারণে ইঁদুর নিধনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আমরা বিভিন্নভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি। আর এজন্যই হোসেন আহম্মদের মতো কৃষকদের কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সবসময় পরামর্শ দেওয়া হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। এতে তারা নিজেদের সম্মানিত বোধ করেন।

ইঁদুর,নেশা,পুরস্কার

সারাদেশ

অনুসন্ধান করুন
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close