এই ছবিটা আসিফ-ন্যান্সির দ্বন্দ্বের কথা বলে না
কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর এবং নাজমুন মুনিরা ন্যান্সির এই ছবিটা তোলা হয় গত ২৯ জুলাই ২০২২। স্থান— রাজধানীর বনানীতে এক রেস্টুরেন্টে। ওইদিন ছিল ন্যান্সির কনিষ্ঠতম কন্যা আমায়রা ইউসরা’র মুখ দেখা অনুষ্ঠান।
সম্প্রতি আসিফ আকবর এবং ন্যান্সির পুরনো দ্বন্দ্ব আবার নাড়াচাড়া দিয়ে উঠেছে। গণমাধ্যমের কল্যাণে সবাই জেনেছেন— বনানীর ওই রেস্টুরেন্টে নিমন্ত্রিত ছিলেন আসিফ আকবর। ন্যান্সি-ই তাকে নিমন্ত্রন জানান। অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে তিনি ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। পোস্ট-এ দুই শিল্পীর অনভিপ্রেত দ্বন্দ অবসানের ইঙ্গিত ছিল।
সম্পর্কিত খবর
এই দুই শিল্পীর যারা শুভাকাঙ্খী, তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। আসিফ আকবর বাংলা গানের যুবরাজ। অন্যদিকে ন্যান্সি সময়ের শ্রেষ্ঠ কণ্ঠ। দেশের মিউজিক ইন্ডাষ্ট্রির শীর্ষ দুই শিল্পীর মধ্যে দ্বন্দ থাকুক, তা তাদের শুভাকঙ্খীদের কেউই চাননি। সে কারণেই তারা স্বস্তি পেয়েছিলেন।
কিন্তু তাদের স্বস্তি, অস্বস্তিতে পরিণত হতে বেশি সময় লাগেনি। গত ৩ অগাস্ট ন্যান্সি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক একাউন্ট থেকে একটা পোস্ট দেন। সেখানে তিনি লেখেন—
“আমার সর্বকনিষ্ঠ কন্যাকে দেখার উপলক্ষ্যে অনেক তারকাদের মত আমন্ত্রিত ছিলেন জনপ্রিয় গায়ক আসিফ আকবর। শিল্পী আসিফ আমাদের সবার প্ৰিয় কিন্তু উনার আমার সাথে করা পূর্বের ধারাবাহিক মিথ্যে অসম্মানজনক অন্যায় কথা কোনোভাবেই আমার কাছে ক্ষমার যোগ্য নয়। নিরুপায় আমি আইনের দ্বারস্থ হবার পর বাকি বিষয় চলমান আদালতের বিচার প্রক্রিয়া যা সিদ্ধান্ত নেবেন তাই হবে। আসিফ আকবরের সঙ্গে কোনো ডুয়েট অ্যালবাম করার প্রস্তাব কোনো প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে আসেনি, আসলেও করার প্রশ্নই আসেনা। যথেষ্ট জল ঘোলা হয়েছে, আর নয়। আসিফ আকবরের আমার সঙ্গে গান প্রকাশের ইচ্ছে থাকলে সেটা একান্তই তাঁর নিজস্ব ইচ্ছে, আমার নয়। আমি আমার পূর্বের অ্যালবাম এর প্রাপ্য সম্মানী ফেরত চাই, সস্তা পাবলিসিটি নয়!”
ন্যান্সির এই পোস্ট দেখে মনে হয়— তিনি ভীষণ ক্ষুব্ধ। রাগে তার শরীর কাঁপছে। এবং এতটাই বিরক্ত হয়েছেন যে এমন কড়া একটা পোস্ট না লিখে আর পারেননি।
ঘটনাক্রমে, ন্যান্সির কনিষ্ঠ কন্যার ওই অনুষ্ঠানে আমিও হাজির ছিলাম। সে কারণেই ন্যান্সির এই রাগ-ক্ষোভ দেখে ভীষণ অবাক হয়েছি। ঘটনার আগে এবং পরের নানাবিধ বিষয় আমার জানা আছে।
গত ২৯ জুলাই ২০২২ কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবর আমাকে ফোন দিয়ে বললেন— চলো, তুমি আর আমি বনানী যাবো। ওখানে ন্যান্সির মেয়ের মুখ দেখা অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানে আমি নিমন্ত্রিত না। যাওয়ার পথে সেটাই ভাবছিলাম। আসিফ আকবর বললেন— তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি এই ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষী হতে। ন্যান্সিকে আমি স্নেহ করি। নানান কারণে তার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তবে তার ফোন পেয়ে সব রাগ ভুলে গেছি। আমি চাই, ন্যান্সির সঙ্গে আমার পূণর্মিলনের তুমি চাক্ষুষ স্বাক্ষী থাকো।
কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবরের জীবনী গ্রন্থ ‘আকবর ফিফটি নট আউট’ আমি লিখেছি। সেখানে ন্যান্সির সঙ্গে তার সম্পর্ক ও দ্বন্দের ব্যাপারটাও আছে। আসিফ আকবর হয়তো সে কারণেই ঘটনার ধারাবাহিকতার অভিজ্ঞতা আমাকে দিতে চাচ্ছিলেন।
অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে দেখি কণ্ঠশিল্পী, মিউজিক ডিরেক্টর বাপ্পা মজুমদার এসেছেন তার স্ত্রী তানিয়াকে নিয়ে। উপস্থাপক ফারহানা নিশো , সোলস এর গিটারিস্ট মাসুমসহ মিউজিক অঙ্গনের আরো কিছু মানুষ। তবে কোনো অর্থেই এটা তারকার মেলা নয়। ঘরোয়া অনুষ্ঠান বলাই শ্রেয়।
অনুষ্ঠানস্থলে আসিফ আকবর উপস্থিত হওয়ামাত্রই সবাই ছুটে এলেন হৈহৈ করে। ন্যান্সি এবং তার স্বামী মহসিন মেহেদীও এলেন। আসিফ ও ন্যান্সির আলিঙ্গনবদ্ধ হওয়া সেই দৃশ্যের স্বাক্ষী হলাম আমি।
সংস্কৃতিমনা মানুষেরা উদার হন। একইসঙ্গে আবেগী হন। সে কারণেই মাঝে-মধ্যে দ্বন্দ তৈরি হয়। দুজন শিল্পীর মধ্যে দ্বন্দ তৈরি হওয়া যেমন অস্বস্তির, তেমনি দ্বন্দ মিটে যাওয়াটা ভীষণ স্বস্তির। পৃথিবীর সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটা।
আসিফ-ন্যান্সির আলিঙ্গন দেখে মনে হল— পৃথিবীর সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটা দেখছি। এই দৃশ্যের স্বাক্ষী হতে পেরে নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবান মনে হল।
আসিফ আকবর, ফারহানা নিশো এবং আমি একটা টেবিলে বসে গল্প করছিলাম। একটু পরই সেখানে এসে বসলেন ন্যান্সি। সরাসরি আসিফ আকবরকে বললেন— আমাকে আর কোনোদিন ‘শর্ট টার্ম মেমোরি লস’ বলবেন না। লোকে আমাকে পাগল মনে করে।
আসিফ আকবর অভিযুক্তের ভঙ্গিতে হাত দিয়ে নিজের কান ধরলেন। বললেন— আর কোনোদিন বলব না।
হেসে দিয়ে ন্যান্সি কপট অভিমানের সুরে বললেন— কালই তো ভুলে যাবেন। আবার আমাকে গালিগালাজ করে ফেসবুকে পোস্ট দিবেন।
আসিফ আকবরও হেসে উঠলেন। বললেন— না। আর এসব করব না।
সামনে বসে সঙ্গীতাঙ্গনের দুই শীর্ষ যাত্রীর এই খুনসুটি উপভোগ করছিলাম আমরা।
অনুষ্ঠানে ছোট্ট একটা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে কয়েকজন মিউজিশিয়ান বসে গান গাচ্ছিলেন। সেদিকে ইঙ্গিত করে ন্যান্সি বললেন— আপনার কিন্তু গান গাইতে হবে। অনেকগুলো গান গাইবেন। ‘উড়ো মেঘ’টা অবশ্যই গাইবেন।
ন্যান্সির কথায় আসিফ সম্মতি জানালেন।
কথায় কথায় আসিফ আকবরকে ন্যান্সি বললেন— আপনি কিন্তু আমার দেশী এখন।
কিভাবে? আসিফ জানতে চাইলেন।
আমার বরের বাড়ি তো কুমিল্লায়। ন্যান্সি বললেন।
আসিফ বললেন— দেখেছো, বেস্ট প্লেয়ারগুলোর বাড়ি কিন্তু কুমিল্লাতেই।
এ কথায় চারপাশের সবাই হেসে উঠলেন।
গল্প-গুজবের ফাঁকে চলছিল খাওয়া-দাওয়া। শেষে গান গাওয়ার পালা। এর মধ্যে স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেছেন বাপ্পা মজুমদার। যাওয়ার আগে তারা জানালেন, উত্তরাতে আরো একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হবে তাদের।
মঞ্চের পাশে বসে আসিফ আকবর গান ধরলেন— এখনো মাঝে মাঝে, মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে। উপস্থিত সবার মধ্যে এক ধরণের প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করলাম। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আসিফ আকবর এখনো ধারালো। সবাই আসিফের সঙ্গে গলা মেলালেন।
দ্বিতীয় গান গাইলেন— উড়ো মেঘ। মঞ্চের আরেক পাশে বসে মাইক্রোফোন হাতে তুলে নিলেন ন্যান্সি। সময়ের সেরা দুজন শিল্পীর যৌথ পরিবেশনা উপস্থিত সবাইকে আচ্ছন্ন করে তুলল।
আসিফ আকবর আরো দুটো গান গাইলেন। এত দীর্ঘক্ষণ প্রফুল্লমনে কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে তাকে খুব কম দেখেছি। স্নেহভাজন ন্যান্সির সঙ্গে দ্বন্দের অবসান হওয়ার এই উপলক্ষই হয়তো তাকে প্রফুল্ল করে তুলেছিল।
ফেরার সময় ন্যান্সি বললেন— আসিফ ভাই খুব ভালো লাগলো। শিগগিরই আমার বাড়িতে আরেকটা অনুষ্ঠান আয়োজন করব। নিজেরা নিজেরা। সেখানে আপনি আসবেন। আমরা আড্ডা দিব।
ফেরার পথে আসিফ আকবরকে জিজ্ঞেস করলাম— এখন মামলাটার কী হবে? ন্যান্সি কি মামলা তুলে নিবেন?
আসিফ আকবর বললেন— না। মামলা মামলার মতো চলবে। আইন তার নিজস্ব গতিতে থাকবে। আমরা দুজন খুব কাছের মানুষ ছিলাম। মাঝখানে কিছু তিক্ততা তৈরি হয়েছিল। সেকারণেই মামলাটা আমাদের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। এখন সম্পর্কটা ঠিক হয়ে গেল।
তারপরই ফেসবুকে আসিফ আকবরের সেই পোস্ট। সেখানে তিনি স্পষ্ট করেই বুঝিয়েছেন— ন্যান্সিকে তিনি স্নেহ করেন। ভালোবাসেন। ওই পোস্ট-এ তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন— ন্যান্সির সঙ্গে তার তিক্ততার সম্পর্কের অবসান ঘটতে চলেছে কিংবা ঘটেছে।
আসিফ-ন্যান্সির হাস্যোজ্জ্বল ছবিটা এতক্ষণের এই গল্পের পক্ষেই কথা বলে।
কিন্তু ন্যান্সির ফেসবুক পোস্ট যেন উলে্টা চিত্র প্রকাশ করছে। আসিফ আকবরকে এই পোস্ট এর মাধ্যমে তিনি প্রকাশ্যে অসম্মান করেছেন। আমার জানামতে, আসিফ আকবর কোথাও একবারের জন্যও বলেননি— তিনি ন্যান্সির সঙ্গে নতুন করে গান করতে চান। তাহলে এ বিষয় অবতারণার যৌক্তিক কারণ আছে কি?
‘শর্ট টার্ম মেমোরি লস’ একটি রোগ। এই রোগের কেতাবি নাম— অ্যান্টিরোগ্রেড অ্যামনেসিয়া (Anterograde Amnesia)। বলিউডের জনপ্রিয় মুভি ‘গাজিনি’র কল্যাণে এই রোগের ধরণ সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। মুভিটির হিরো আমির খান যে চরিত্রটিতে অভিনয় করেন, সেই সঞ্জয় সিনহানিয়া অ্যান্টিরোগ্রেড অ্যামনেসিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। কিছুক্ষণ আগের কথা একটু পর ভুলে যাওয়াই এই রোগের বৈশিষ্ট্য।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস— কণ্ঠশিল্পী নাজমুন মুনিরা ন্যান্সি এমন কোনো রোগে আক্রান্ত নন। তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক একজন মানুষ। ২৯ জুলাই ২০২২ তারিখে তার কণিষ্ঠ কন্যার মুখ দেখা অনুষ্ঠানে যা যা ঘটেছে, তার সবই ন্যান্সির মনে আছে।
আমার আরো বিশ্বাস— সেদিনের কথা ঠাণ্ডা মাথায় একবার ভেবে দেখলে ন্যান্সির রাগ-ক্ষোভ কমে যাবে। কেননা, সেদিন দেশের মিউজিক ইন্ডাসি্ট্রর শীর্ষ দুজন শিল্পী অনেকগুলো মানুষকে পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্যগুলোর একটা উপভোগের সুযোগ দিয়েছিলেন।
সোহেল অটল: সাংবাদিক ও লেখক [email protected]
পূর্বপশ্চিম- এনই