• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

আসিতেছে ‘আন্দোলন’

প্রকাশ:  ০৭ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:৪৯
সৈয়দ বোরহান কবীর

ছোট বেলায় রেডিওতে সিনেমার বিজ্ঞাপন আমাকে খুব টানতো। ভরাট কণ্ঠে ‘আসিতেছে, এই প্রেক্ষাগৃহে সম্পূর্ণ রঙিন’ ইত্যাদি নানা রোমাঞ্চকর কথা বার্তা শুনে চোখে যেন ছবির দৃশ্য ভেসে উঠতো। এত বছর পর বিএনপির আন্দোলনের ঘোষণা নিয়ে আমার সেই বিজ্ঞাপনের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। গত প্রায় এক বছর ধরে ‘আন্দোলন’ এর ঘোষণা দিচ্ছে বিএনপি। আসিতেছে ‘আন্দোলন’। রোজার ঈদের সময় বিএনপি মহাসমারোহে ইফতার উৎসব করলো। বিএনপি নেতাদের মধ্যে তরতাজা ভাব। ক্ষমতার ঘ্রাণ পাচ্ছেন তারা। চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস আনন্দ। পত্রিকার পাতায় লেখা ‘ঈদের পরই চূড়ান্ত আন্দোলনে যাবে বিএনপি।’ আমরা অপেক্ষায় থাকলাম। ঈদের পর আন্দোলন শুরু হলো বটে, তবে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আওয়ামী লীগের পতনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা হলো ফেসবুকে, ইউটিউবে। এসব দেখে শুনে আওয়ামী লীগের নেতারা কিঞ্চিৎ শঙ্কিত। বিএনপির কর্মীরা রীতিমতো উত্তেজিত। কিন্তু আন্দোলন মাঠে গড়ায় না। বিএনপির এক নেতা বললেন ‘ওয়ার্ম আপ চলছে।’ কিন্তু ওয়ার্ম আপ করতে করতেই বিএনপির কর্মীরা ক্লান্ত। ওদিকে আওয়ামী লীগের এক নেতা হাক দিলেন ‘খেলা হবে।’ আমরা আম-জনতা খেলা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম। রোজার ঈদের পর বিএনপি সমাবেশ করে। পদযাত্রা করে। বিভিন্ন দলের সাথে বৈঠক করে। তাওয়া গরম হচ্ছে। এর মধ্যেই ঈদ-উল-আযহা এসে গেল। বিএনপির নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন ‘ঈদের পর চূড়ান্ত আন্দোলন।’ আমাদের অপেক্ষার প্রহর বাড়লো। ওমা। ঈদের পরও অনুশীলন আর প্রস্তুতি। ‘এক দফা’ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে বিএনপি নেতারা এক যোগে চিকিৎসা পর্যটনে সিঙ্গাপুরে গেলেন। স্বাস্থ্যের যত্ন তো নিতেই হবে। স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে আন্দোলন করবে কি করে। বিএনপির কর্মীরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করেন, ‘সিঙ্গাপুর থেকে নেতারা দেশে ফিরলেই সরকার ফেলে দেবে।’ সরকার যেন একটা পরিত্যক্ত আসবাবপত্র। ইচ্ছে হলো আর টুক করে ফেলে দিলো। বিএনপির এক নেতা ঘোষণা করলেন ‘আগস্টেই সরকারের শেষ।’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হলো গুজবের উৎসব। সরকারের পতন কিভাবে হবে, তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে ফেসবুকে, ইউটিউবে। আগস্টে কিছু কর্মসূচি পালন করে বিএনপি নেতারা হঠাৎ চুপচাপ। একজন আমাকে বললেন ‘দম নিচ্ছে। আন্দোলন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে তো।’ আমি একটু অবাক হলাম, আন্দোলন হলো কোথায়? হ্যাঁ, আন্দোলন হয়েছে বটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিদেশে বসে কিছু ব্যক্তি নিরন্তর শব্দ বমি করে যাচ্ছেন। সরকারের পতনের দিনক্ষণ ঘোষণা করছেন। এসব দেখে যে কারো মনে হতে পারে যে দেশে একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হয়তো চলছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যখন আন্দোলন নিয়ে সাজ সাজ রব, তখন মূলধারার গণমাধ্যমে চুপচাপ বসে থাকে কি করে। সংবাদপত্র, টেলিভিশনেও শুরু হলো আন্দোলনের আগমনী বার্তা ঘোষণা। আগস্টে লেখা হলো ‘সেপ্টেম্বরেই চূড়ান্ত আন্দোলন।’ কিন্তু সেপ্টেম্বরে বিএনপি নেতারা ব্যস্ত ছিলেন নানা কারণে। এজন্য মাঠে নামতে পারেননি। তবে সাইড লাইনে বসে পদযাত্রা, রোডমার্চ এর মতো কিছু শরীর চর্চা জাতীয় কর্মসূচি পালন করেছেন বটে। এসময় হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার বার্তা ঘোষিত হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার জানিয়ে দেন, গত ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছিল, তা কার্যকর শুরু হয়েছে। ব্যস, আর যায় কোথায়। সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। দেশে যেন আর কোন বিষয় নেই। বিএনপিতে শুরু হলো উৎসব। মাঠে নামলেন সুশীলরা। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেন দিগভ্রান্ত। সরকার কবে পদত্যাগ করবেন? এনিয়ে শুরু হলো বিতর্ক নানা জল্পনা কল্পনা। ভিসা নিষেধাজ্ঞায় কারা, তার তালিকা তৈরীর হিড়িক চললো কদিন। আওয়ামী লীগের আমলে হালুয়া রুটি খাওয়া এক সুশীল ঘোষণা করলেন, সরকারের পতন আসন্ন। বিএনপি নেতারা খুশিতে আত্মহারা। এর মধ্যেই তারা বেগম জিয়ার মুক্তি দাবি করলেন। বিএনপি চেয়ারপারসনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেবার জন্য সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়া হলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হলো আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায় বার্তা। আওয়ামী লীগের কোন নেতা কোথায় পালাবেন, তাও ঘোষণা করলো অনেকে বিদেশে বসে। সেপ্টেম্বর গড়িয়ে গেল। সরকারের পতন হয় না। বিএনপি সহ বিরোধীদল গুলোর চূড়ান্ত আন্দোলনও শুরু হয় না। এবার বিএনপি নেতারা ঘোষণা দিলেন ‘অক্টোবরেই সরকারের পতন ঘটবে।’ বিএনপির প্রভাবশালী নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর এই নিশ্চিত বার্তার পর দলটির মহাসচিব চুপচাপ বসে থাকেন কি করে? তিনিও ফিসফাস করে বললেন আগামী কয়েকটা দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। অক্টোবরের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। বিএনপির এক দফা আন্দোলন মানে সভা-সমাবেশ আর মোটর বাইকে ভ্রমণ। এর মধ্যে ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম জিয়াকে বিদেশ যাত্রার অনুমতি দেয়া সম্ভব না।

যেকোন আলটিমেটাম দেয়ার পর দাবি আদায়ের জন্য বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়। বিএনপি নেতাদের ৪৮ ঘণ্টা কতদিন পর হয় আমার জানা নেই। বিএনপির আন্দোলন জমে না। শুধু পত্রিকার পাতায় দেখি, বিএনপি এটা করবে, সেটা করবে। কোন দিন শুনি টানা কর্মসূচি আসছে। আবার কখনো পত্রিকায় পাতায় দেখি, কঠোর কর্মসূচি আসছে। তাহলে এতোদিন কি ছিলো? জনগণ বিএনপির আন্দোলনের অপেক্ষায় ক্লান্ত। বিএনপির কর্মীরাও বিরক্ত। কিন্তু বিএনপি নেতারা যে কিসের অপেক্ষায়? বিএনপি কি লন্ডন থেকে সংকেতের অপেক্ষা করছে? লন্ডন থেকে হুইসেল বাজানো হবে আর বিএনপি যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়বে। সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করবে? নাকি, বিএনপি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, কয়েকজনের ভিসাও বাতিল করেছে। সামনে আরো স্যাংশন আর নিষেধাজ্ঞা দেবে। ব্যস, সরকার সুড়সুড় করে পালিয়ে যাবে। ক্ষমতা ছেড়ে দেবে। এমন আশায় কি প্রহর গুনছে বিএনপি? ইদানিং বিএনপি নেতাদের কথাবার্তায় তাই মনে হয়। কদিন আগে বিএনপি মহাসচিব বলেছিলেন ‘বিদেশীরাও এই সরকারকে চায় না।’ বিদেশীরা চায় না, তাই সরকারের পতন হবে-বিএনপি বেশীর ভাগ নেতা এমনই আশায় বুক বেঁধে আছেন। কোন কোন নেতা বলছেন, ‘আমাদের কিছু করতে হবে না। যুক্তরাষ্ট্রই সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটাবে।’ তাই যদি হয়, তাহলে এতো হুমকি, ধমকি কেন? আন্দোলন নিয়ে এতো চটকদার হুশিয়ারি বা কেন?

সব কিছু দেখে শুনে মনে হয়, আন্দোলন না। বিএনপি এখন এক অদ্ভুত ফ্যান্টাসী জগতে বসবাস করছে। এই ফ্যান্টাসী তৈরী করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু বাগীশ অর্বাচীন। এরা অবিরত এমন ভাবে মিথ্যাচারের নেশা ছড়াচ্ছে যে বিএনপির অনেকেই তাতে বুঁদ হয়ে আছেন। বাংলাদেশে এখন দুটি জগৎ তৈরী হয়েছে। একটি বাস্তব জগৎ। যেখানে মানুষ কর্মব্যস্ত। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। অন্য একটি জগৎ হলো সোশাল মিডিয়ার গোয়েবলসীয় মিথ্যাচারের জগৎ। যেখানে গেলে আপনার মনে হবে, দেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সরকার যেকোন সময়ে পালিয়ে যাবে। অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত হয়ে ফ্যান্টাসী জগতে চলে যাচ্ছেন। ভুতের ছবি দেখে যেমন অনেক সময় গা ছম ছম করে। তেমনি বিদেশে বসে যারা অবিশ্রান্ত ধারায় বকবক করছেন, তাদের কথা বার্তা শুনেও অনেকে আঁতকে উঠেন। এদের এসব বকবকানী আবার প্রচুর মানুষ শোনেনও। লাখ লাখ মানুষ এসব অশ্রাব্য অখাদ্য নিয়মিত ভক্ষণ করে দিশেহারা। ফলে সমাজে একটা ভ্রান্ত আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা তৈরী হয়েছে। একটা মিথ্যা দশবার বললে নাকি সত্যি হয়। হাজার বার বললে যেন মহাসত্যে পরিণত হয়। এজন্যই চলছে মিথ্যার বিরামহীন বৃষ্টি। মূলধারার গণমাধ্যমও এসবে আলোড়িত। তারাও আন্দোলনের আবহ সৃষ্টিতে মরিয়া। সুশীলরা অস্থির। তারা মনে করছেন, আরেকবার মসনদ দখলের সময় এসে গেছে। বিএনপি একটু গরম করলেই পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যাবে। তখনই তাদের ডাক পড়বে। ইদানিং সুশীলদের লেখা লেখি পড়লে আমার দুটি জিনিস মনে হয়। প্রথমত, বিএনপিকে জ্বালাও, ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগ করছে না, এনিয়ে তাদের অস্থিরতা। এই অস্থিরতা ধৈর্য্যের সীমা প্রায় অতিক্রম করেছে। একজন সুশীল দেখলাম সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বিএনপিকে এখনই কিছু একটা করতে হবে।’ সুশীলদের কেউ কেউ বিএনপিকে ধরে বেঁধে আন্দোলনে নামাতে চায়।

দ্বিতীয়ত, সুশীলদের আরেক অংশ যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র কেন আরো কঠোর হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র কেন অবরোধ দিচ্ছে না। গার্মেন্টস রপ্তানি বন্ধ করছে না, এনিয়ে তাদের অনেক গোস্বা। একজন সুশীল সাক্ষাৎকার দিয়ে বললেন, ‘ভিসা নিষেধাজ্ঞায় কিছু হবে না।’ তিনি বললেন, ‘যে সব দেশে এসব ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেখানে ফল পাওয়া যায়নি।’ প্রথমে এই সুশীলরা আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করেছে। টকশোতে উপস্থিত হয়েছেন ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রভাবে কি কি হতে পারে তার দীর্ঘ তালিকা নিয়ে। কিন্তু এরকম ‘গুজব’ ছড়িয়ে তারা লাভবান হতে পারেনি। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ দুপক্ষই অর্থনৈতিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গার্মেন্টস মালিকরা বলেছেন, তাদের ব্যবসায় এর প্রভাব পড়বে না। তখন সুশীলরা যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দিতে চাইছে। এসবে কিছু হবে না। আরো কঠোর হও। বাংলাদেশের সর্বনাশেই যেন তাদের সন্তুষ্টি।

বিএনপিও এখন সুশীলদের ওপর অভিমান করেছে। সুশীলরা তাদের বলেছিল গোঁ ধরে বসে থাকো। আমেরিকা সরকারকে হটিয়ে দেবে। আমরাই তো যুক্তরাষ্ট্রের ‘খাস’ লোক। কিন্তু আমেরিকা তো সরকারকে চিমটি দিচ্ছে, জোরে মাথায় বাড়ি দিচ্ছে না। বিদেশীরা চাপ দেবে। আন্দোলনে রাজপথ গরম হবে। সরকারের পতন হবে। এই সূত্র ক্রমশ অকার্যকর এবং ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। বিদেশীরা একটু চাপ দিয়ে তাকিয়ে দেখছে বিরোধী দলের দিকে, তারা কি করে। বিরোধী দল গুলো পদযাত্রা করে তাকিয়ে আছে সুশীলদের দিকে। আরো চাপ কবে সেই প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে পশ্চিমা দেশের দূতাবাসে ধর্ণা দিচ্ছে। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু বানর খেলা দেখাচ্ছে। আমরা জনগণ তাকিয়ে তামাশা দেখছি। জনগণকে দর্শক বানিয়ে যারা আন্দোলনের কুস্তি খেলছেন, তারা অচিরেই ক্লান্ত হবেন।

সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

সূত্র: বাংলা ইনসাইডার

আন্দোলন,সৈয়দ বোরহান কবীর
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close