ভাবনার আকাশে মানুষকেই ভাসতে হয়
মানুষ খুব অদ্ভুত ধরনের। কেন যে মানুষের মগজটা বিগড়ে যায় কে জানে। সবার ভেতরে একটা ভালো মন হয়তো আছে; কিন্তু সেটা জাগ্রত নয়, ঘুমন্ত। ভাবুন তো আগের দিনে একজন গ্রাম দেশের চোরের কথা। বেচারা খাবারের অভাবে একবার কিংবা দুবার হয়তো কারও বাড়িতে সিঁধ কেটে চুরি করেছে। চোরের বউটার কথা ভাবুন, ঘুমিয়ে পড়া দুটো অভুক্ত হাড়গোড় বের হওয়া কাদামাটিতে গড়াগড়ি খাওয়া সন্তানের কথা ভাবুন। বউটাও নরম হাত দিয়ে চোরটার উদোম শরীরে তেল মাখিয়ে দিচ্ছে। চুরি নয়, যেন বিশ্বজয় করতে চলেছে বেটা চোর। হাবাগোবা চেহারা। আর গোলগাল বউটা চোর চলে যাওয়ার পর আতঙ্কে না ঘুমিয়ে থেকেছে। হুতোম বেচারার ডাক, শিয়ালের চিৎকার, ভূত ভূত ভয় লেগে সোনার অঙ্গ কেঁপে উঠেছে। আবার চোরটা তো তার আদরের বর, তার জন্যও দুশ্চিন্তায় দুই চোখের পাতা এক করতে পারেনি। আপনারা হয়তো বলবেন আহা মশাই, চোরের জন্য এত আবেগ, এত দরদ, কী এমন সাধু-সন্ন্যাসী, হারামজাদা তো একটা চোর। আর ওই চোরটাকে নিয়ে ইনিয়েবিনিয়ে লিখেই চলেছেন, এত আবেগ তো ভালো নয়, তার একটা লিমিট থাকা দরকার। না, আমি সেটা বলছি না। বেচারা চোরটা নেংটি বেঁধে শাবল দিয়ে সিঁধ কাটছে। বরফ গলা শীতের রাতেও ক্লান্ত শরীর থেকে দরদর করে লবণাক্ত ঘাম ঝরছে। আবার ধরা খাওয়ার আতঙ্ক। ভয়ে চুপসে গেছে শুকনো মুখটা; কিন্তু চোখটা গোল গোল করে বড় হয়ে গেছে। একটা মহাজন গোছের লোকের বাড়িতে সিঁধ কেটে ঢুকে পড়েছে। কী পেয়েছে। হয়তো খুব বেশি হলে দুই সের চাল, আধ সের ডাল আর আধা সের আলু। এর সঙ্গে ভুঁড়িওয়ালা মহাজন আর তার মহারানির নাকের গর্জন।
এত কিছুর পরও যখন চুরি করে বীরের মতো বাড়িতে ফিরেছে, তখন চোরদের বাড়িতে ঈদ কিংবা পূজার মতো উৎসব। বউ সারাদিনের কুড়িয়ে আনা গাছগাছালির পাতা, কিছু গাছের শুকনো ডালপালা দিয়ে মাটির উনুনে আগুন ধরিয়ে ভাত রেঁধেছে। মশলাপাতি ছাড়াই সামান্য লবণ দিয়ে ডাল আর আলুর ভর্তা বানিয়েছে। এরপর প্রাণপ্রিয় সন্তানদের ডেকে তুলে রাজা-রানিদের মতো ঢেঁকুর তুলে আয়েশ করে খেয়েছে। তখন ভাবেনি পরের দিনটার কী হবে। আর যদি ভাগ্য খারাপ হয়, ধরা পড়ে যায় তবে তো কথাই নেই পুলিশের বড় কর্তারা উল্টোভাবে গাছে ঝুলিয়ে যেমন খুশি তেমন উত্তম-মধ্যম দিয়েছে। আর বউ হয়েছে চোরের বউ। ছেলেমেয়েরা হয়েছে চোরের ছেলেমেয়ে। গোটা বংশটার নাম হয়ে গেছে চোরের বংশ। আহা! বেচারাদের লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা নেই। কোথায় লুকাবে পৃথিবীটাই তো গোল। কিন্তু ভাবুন তো মহাশয় একবার, খুব বড় শিক্ষিত হয়েছেন। স্যুট-পেন্ট পরেছেন। শরীরে খুশবুদার বিদেশি সেন্ট মেখেছেন। বউ আর ছেলেমেয়েদের গাড়ি-বাড়ি, এটা-ওটা এমন কিছু নেই যে কিনে দেননি। একটা নয়, দুটা নয়, তিনটা নয়, দশ-দশটা বাড়ি-গাড়ি করেছেন। বড় অফিসে সরকারি চাকরি করেন। খুব কদর আপনার।
সম্পর্কিত খবর
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিতেছেন। মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই চলছে। এরপর আপনার বিরুদ্ধে লড়াই হবে। সেটার নাম চোরদের বিরুদ্ধে লড়াই নয়। ভদ্র ভাষায় যাকে বলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই। সময় থাকতে তাই সাধু সাবধান। আর একটা কথা মনে রাখবেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অবস্থানকে সুস্পষ্ট উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের দৃঢ় অবস্থান সুস্পষ্ট।’ নাগরিকদের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য একটি ওয়েবভিত্তিক অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা পরীক্ষামূলকভাবে চালুর উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ সংশোধন করা হয়েছে। তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ এবং জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১ প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রণয়ন করা হয়েছে জাতীয় শুদ্ধাচারের কৌশলপত্র।’ প্রধানমন্ত্রী দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব প্রদানের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘ভালো কাজের পুরস্কার আর মন্দ কাজের জন্য তিরস্কারের ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিন। সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো থেকে সেবা পেতে জনগণকে যাতে ভোগান্তির শিকার না হতে হয়, তার উদ্যোগ নিন।’
২. আমি তরুণদের নিয়ে সবসময় ভাবি। আমিও নিজেকে তরুণ বলে মনে করি, হয়তো বয়সটা তরুণদের মতো নয়; কিন্তু মনটা তো তরুণদের মতোই সবুজ। কিন্তু তরুণরা তরুণদের নিয়ে কখনও কি ভাবে। কিংবা তাদের ভাবনার জগৎটা আমরা কি তৈরি করতে পেরেছি। কোথায় যেন একটা তারতম্য। আমরা স্বপ্নবাজ তরুণদের কথা বলি। কিন্তু আমরা কি তরুণদের স্বপ্ন দেখাতে পারছি কিংবা তারা নিজেরা কি নিজেদের স্বপ্ন দেখার মতো করে তৈরি করছে। হয়তো হ্যাঁ বা না যে-কোনো একটা উত্তর আসতে পারে। আগে সৃষ্টশীল স্বপ্ন দেখতে হবে, তারপর পরিকল্পনা আর সব শেষে তার বাস্তবায়ন। যদি বাস্তবায়ন করে সফল হতে পারে আমাদের তরুণরা, তখন তো লেখা হবে তাদের জয়যাত্রার গল্প। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে আমাদের চারপাশে তরুণদের দেখি; কিন্তু চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিজেকে যে গড়ে তুলতে হয়, সে রংবাজ রঙে যেন খানিকটা ঘাটতি পড়েছে, মরচে ধরেছে। আত্মবিশ্বাসেও কেমন যেন একটা ছন্নছাড়া ভাব। এখনকার তরুণরা প্রেম যে একটা শিল্পবোধের পরিচয় সেটাও ভুলতে বসেছে। কোথায় যেন একটা যাযাবর মনের অস্থিরতা। রাতারাতি আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা। আমাদের দেশের ৪৭ লাখ শিক্ষিত তরুণ বেকার। ভাবা যায়? কোনোভাবেই ভাবা যায় না। কেন তরুণরা নিজেদের বেকার রেখেছে এটাই আমার প্রশ্ন? লেখাপড়া করে বের হওয়ার পরই সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে ঢোকার জন্য এক ধরনের ভারসাম্যহীন প্রতিযোগিতা শুরু হয়। তরুণরা ভাবে সরকারি চাকরিটা যেন সোনার হরিণের মতো। না হলে জীবন বরবাদ। এ বিষয়টা খুব হাস্যকর আর যুক্তিহীন। সবাই যদি চাকরি করে তবে চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করবে কারা। কীভাবে বাংলাদেশে নতুন চিন্তাধারার ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে।
আমাদের তরুণদের বলব, চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা কর। কারণ তোমার যেমন আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হওয়া দরকার, তেমনি তোমার মাধ্যমে অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতগুলো মানুষের জীবনকে বদলে দিতে পারবে তুমি এটা কি কখনও ভেবেছ। তুমি একজনকে যদি কাজে নিয়োজিত করতে পার, এর অর্থ হচ্ছে তুমি তার পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে পারলে এর থেকে আনন্দের আর অর্জনের কি কিছু আছে। কিছুই নেই। এখন বলতে পার, উদ্যোক্তা হতে হলে প্রচুর টাকার দরকার। তোমার ধারণা একেবারেই ভুল। এখন তো ইন্টারনেটের মাধ্যমে গোটা পৃথিবী মানুষের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। একটু খোঁজ কর, দেখবে কোনো টাকা ছাড়াই কত ধরনের কাজ করা যায়। শিল্প উদ্যোক্তা হতে হলে এখন আর আহামরি টাকা লাগে না। নতুন ধারণা থেকে ব্যবসাবাণিজ্য টাকা বিনিয়োগ ছাড়াই করা সম্ভব। ফেইসবুকের মাধ্যমে অনেক তরুণ-তরুণী জ্যাকমার আলী বাবা ডটকম, জেফবেজোসের আমাজন ডটকমের মতো অনলাইন ব্যবসা কিন্তু এরই মধ্যে শুরু করেছে, তাদের তো কোনো টাকা লাগেনি। তাহলে তোমরা পারবে না কেন। আমি তো মনে করি বিনা পুঁজিতেই উদ্যোক্তা হওয়া সম্ভব। আমার ধারণা, এটা কেউ তোমরা আগে সেভাবে ভেবে দেখনি বা খোঁজ করনি। তোমাদের এখন চোখ-কান খোলা রেখে এগোনো দরকার।
কীসের চাকরি; তোমাদের বড় বড় শিল্পপতি হতে হবে, হবেই হবে, তবেই না দেশ এগিয়ে যাবে, মানুষের জীবনে সুখ ধরা দেবে। এজন্য কী দরকার? দুটো বিষয় দরকার একটি হলো ইতিবাচক মনোভাব, আরেকটি উদ্যোগ। তোমার হাতেই তোমার জীবন গড়ে উঠতে পারে, গড়ে উঠতে পারে অন্যদেরও জীবন। আর সেটা যে কত আত্মমর্যাদার আর অহংকারের, সেটা যদি বাস্তবে প্রয়োগ কর তবেই সেটা যে কত মহামূল্যবান, তা বুঝতে পারবে। তাহলে এখন কী দরকার? এখন দরকার জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাবার আর বদলে ফেলার। তোমাদের মধ্যরাস্তার দ্বিধাদ্বন্দ্বের বিস্ময় ও আমার দৃঢ় বিশ্বাস থেকে বলছি, চাকরির পেছনে ছুটো না, সময় নষ্ট করো না, বরং সময়কে হাতে নিয়ে চাকরি সৃষ্টি কর। তবেই না তুমি সফল মানুষ। সভ্যতা গড়ার কারিগর। তুমিই হবে সভ্যতার ইতিহাস আর তোমার পেছনে ছুটবে সময় আর ইতিহাস। ভারতের শ্রদ্ধেয় জ্যোতির্ময় গোস্বামী একটা মূল্যবান কথা বলেছেন ‘পুঁজি বাদ দিয়েই উদ্যোক্তা? ...মানি না, মানি না! পুঁজি অবশ্যই চাই! তবে স্বপ্ন দেখার পুঁজি, শুভবোধের পুঁজি, মূল্যবোধের মূলধন-মূল্য-রূপ পুঁজি! আপাতত এইখানে থামি?’ দাদা আসলে থেমে যাননি, উনি যেটা বলতে চেয়েছেন, সেটি হলো অর্থ কখনও পুঁজি হতে পারে না। বরং জীবনবোধ আর তা থেকে জাগ্রত বিবেকবোধ মানুষের মধ্যে যে প্রবহবান স্বপ্নের আর শুভবোধের মাহেন্দ্রক্ষণ সৃষ্টি করে সেটিই তাকে জীবন গড়ে তোলার পথ দেখায়। কেমন যেন জয়যাত্রার আগমনি বার্তায় তরুণদের মুখ থেকে শুনতে পাচ্ছি রবীন্দ্রনাথের সংগীতের অমিয় বাণী ‘মুক্ত কর ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধর, নিজেরে কর জয়।’
লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিষ্ট ও ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর