• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
শিরোনাম

ডাকসুর ভোটেও হরিলুট

প্রকাশ:  ১১ মার্চ ২০১৯, ১৯:৫৫
সেলিম আহেমদ

ঋতুরাজ বসন্তের এখন ভরা যৌবন। ফাগুন হারিয়ে যাচ্ছে কালের অতল গহ্বরে। রং ছড়িয়ে ফাগুন হয়েছে প্রেমময়। নতুন ফুল ফুটছে, রক্ত রাঙা কৃষ্ণচূড়া ফুল, গাছে গাছে নতুন সবুজ পাতা গজাচ্ছে। এই লাল আর সবুপঁমফ একটি বাংলাদেশ। ফাগুনেই রক্ত দিয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা মায়ের ভাষা ফিরিয়ে এনেছিল। আর এ ফাগুনেই অনুষ্ঠিত হলো বাংলা নানা ইতিহাসের স্বাক্ষী ডাকসুর নির্বাচন। দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে কথা ছিল ক্যাম্পাস জিতবে। কিন্তু না মানুষের দীর্ঘ প্রতিক্ষা বিফল হলো। জয় জয় হলো ভোট লুঠেরাদের।

মনের ভেতর নানা শংকা রেখেও ডাকসুর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল দেশের প্রতিটি ছাত্রসংগঠন। অথচ এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না দাবি করে এসব ছাত্রসংগঠনগুলোর অভিবাবক সংগঠনরা সদস্য শেষ হওয়া ঢাকা সিটি কর্পোরেশ নির্বাচন ও চলমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। এর আগে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোট, জাতীয়পার্টি ছাড়া প্রায় সব দলই ভোটে নজিরবিহীন কারচুপি ও ভোটডাকাতির অভিযোগ এনে নির্বাচন বয়কট করেছে। তারা পুনরায় নির্বাচনে দাবিতে আন্দোলনও চালিয়ে যাচ্ছে। ভোটের পরপরই তার দাবি করেছিল এ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। ভোটও সুষ্টু হবে না। তাদের এ শংকাগুলো সত্যই হলো।

ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে জালভোট, ব্যালটবাক্স উধাও, কেন্দ্রদখল, কারচুরি এবং অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রলীগ ছাড়া প্রায় সব প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তারা মঙ্গলবার থেকে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন। পাশাপাশি ভোটের পরপরই এ নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ দাবি করে পুনঃতফসিল ঘোষণার দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছেন। গণমাধ্যমে খবর এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ হলে ভোট চলাকালিন সময়ে রোকেয়া হলের ভোটগ্রহণ কক্ষের পেছনের আরেকটি ক্ষ থেকে ব্যালট পেপার বোঝাই ট্রাংক পাওয়া গেছে। ছাত্রলীগের পক্ষে সিল মারা ব্যালট বাক্স ভোটগ্রহণের আগেই কুয়েত মৈত্রী হলে পাওয়া গেছে। পরে বিক্ষব্ধ ছাত্রীরা রাতের আঁধারে জাল ভোট দিয়ে ব্যালট বাক্সে ভরে রাখার অভিযোগে প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ ও প্রক্টর ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানিকে অবরোধ করে রাখে। বিক্ষুব্ধরা প্রোভিসির প্রাইভেটকারটি জাল ভোটের ব্যালট দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। তারা বলছে- এ ভোট লজ্জার ভোট। এ ঘটনায় হলের ভারপ্রাপ্ত প্রভোস্ট ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শবনম জাহানকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ছাত্রলীগের হামলায় নির্বাচনে কোটা সংস্কার আন্দোলনের (বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ) প্যানেল থেকে ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নূরসহ তিন প্রার্থীও রক্তাক্ত হয়েছেন।

ডাকসুর নির্বাচন নিয়ে ২৮ বছর থেকে প্রতিক্ষার প্রহর গুনছিল গোটা দেশের মানুষ। কারণ এই ডাকসুই হলো ছাত্রনেতৃত্ব বিকাশের সফল কারখানা, সংস্কৃতি চর্চার বাতিঘর।

ডাকসুর নির্বাচন শুধুই নির্বাচন নয়, ডাকসুর বাংলার নানান ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী, ডাকসুর বদৌলতে জন্ম হয়েছে অনেক বাঘা বাঘা জাতীয় নেতার। ডাকসুতে যারা বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা জাতীয় সংকটের সময়ে অনেক অবদান রেখেছেন। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’নির্বাচন, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০’র গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ডাকসুর নেতাদের অনবদ্য অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন।

ডাকসুর নির্বাচনের হাওয়া ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো দেশ জুড়েই। মানুষ আশাবাদি ছিল, অনেকদিন পর নিভে থাকা এই বাতিঘর থেকে ফের আলো জ্বলবে, সে আলোয় আলোকিত হবে হাজারো স্বপ্ন। কিন্তু তাহলো না। ডাকসুতে জয় হলো ভোট লুঠেরাদের। এ ভোটকে পুরো জাতি ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছেন। ঘটনার পরপরই সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সমাজ আর রাজনৈতিক বিশ্লেষক আর সুধীজনরা বলছেন, ‘ এ নির্বাচন হওয়া থেকে না হওয়াই ভালো ছিল’।

স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম ডাকসুর নির্বাচনে বিজয়ী ভিপি ও বর্তমান কমিউনিষ্ট পার্টির সভাপতি মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের সরকারের সময়েও ডাকসু নির্বাচনে এমন কলঙ্ক হয়নি। এ ঘটনা গোটা জাতির জন্য বড় লজ্জার। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান গোটা দেশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পারেনি।

দীর্ঘ ২৮ বছর অপেক্ষার পর ডাকসু নির্বাচনও অন্যান্য নির্বাচনের মতো কলঙ্কিত হলো বলেও দাবি করেন তিনি। সেলিম বলেন, ‘এটাই বর্তমান সরকারের নির্বাচনী সংস্কৃতি। নির্বাচনের নামে জালিয়াতি করার সংস্কৃতি রুখে দেয়ার সময় এসেছে এখন।’

যে ডাকসু হার মানেনি বায়ান্ন, উনোসত্তর, একাত্তরে কিংবা আশির দশকে। আইয়ুব, ইয়াহিয়া কিংবা সামরিক জান্তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে খেলার দুঃসাহস দেখান নি। সেই ডাকসুতে জয় হলো ভোট লুঠেরাদের। জয় হলো এক কলঙ্কময় ইতিহাসের।


লেখক: সাংবাদিক

ডাকসু
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত
close